ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করা কেন ক্ষতিকর?
ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করার গুরুতর ক্ষতি
নূর আহমদ
ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করার ক্ষতি
নূর আহমদ
ডায়াবেটিস বংশগতভাবেও হয়, প্রচলিত এই ধারণা বা বিশ্বাস বিশ্বব্যাপী মানুষের ক্ষতি করে যাচ্ছে ভয়াবহভাবে। ব্যাপকহারে প্রচারের কারণে অসংখ্য মানুষ এখন বিশ্বাস করছে, ডায়াবেটিস একটি বংশগত বা জিনগত রোগ। বাপ-দাদা বা মা-নানি অথবা পূর্বপুরুষদের কারও ডায়াবেটিস থাকলে সন্তানও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
ডায়াবেটিস সম্পর্কে প্রচারিত এই বিশ্বাসের বাস্তবতা যাচাইয়ের আগে দেখে নিই, কোন কোন রোগ বাবা-মা থেকে সন্তানের শরীরে সংক্রমিত হয় এবং কখন একটি রোগ বাবা-মায়ের শরীর থেকে সন্তানের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে? শুধুমাত্র সন্তান গর্ভধারণের সময় থেকে সন্তান মাতৃদুগ্ধ পান করা পর্যন্ত সময়ে বাবা-মা কোনও রক্তবাহিত রোগে আক্রান্ত থাকলে সন্তানের শরীরে সেই রোগ সংক্রমিত হতে পারে। যেমন: বাত-ব্যথা, এলার্জি, ক্যান্সার এসব রোগ। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে এই সূত্রের কথা কারও মাথায় মোটেই থাকে না। হয়তোবা অনেকের এই সূত্রের কথা জানাও নেই।
ধরুন, আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন ৪০ বছর বয়সে। আপনার বাবা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ১০ বছর আগে, যখন আপনার বয়স ছিল ৩০ বছর। আপনার ডায়াবেটিসকে বংশগত ডায়াবেটিস বলে মন্তব্য করার কি কোনও সুযোগ থাকে? এখন আপনিই বলুন, আপনার জন্মের সময় বা আপনি মাতৃদুগ্ধ পান করা পর্যন্ত সময়ে যে রোগটি আপনার বাবা-মা কারও ছিল না, এমনকি আপনার জন্মের ১-২ বছর পরেও নয়, বরং ৩০ বছর পর আপনার বাবা-মা যেই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, সেই রোগ আপনার শরীরে কীভাবে সংক্রমিত হবে?
আপনার জন্মের ৩০ বছর পর আপনার বাবা যেই কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন, আপনিও আপনার ৪০ বছর বয়সে এসে সেই কারণেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া কি অসম্ভব? কেন আমরা এটাকে অসম্ভব মনে করি? আপনার ডায়াবেটিস আপনার বাবার ডায়াবেটিসের উত্তরাধিকার হতে যাবে কেন? এটাকে অসম্ভব মনে করার কারণেই যত বিপত্তি।
‘একটি রোগ নির্দিষ্ট কারণে শুধু এক প্রজন্মকেই আক্রমণ করতে পারে’, এই অজ্ঞতাপূর্ণ বিশ্বাস থেকেই বংশগত রোগের ধারণা অস্তিত্ব লাভ করেছে। ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে এই অজ্ঞতাপূর্ণ বিশ্বাস ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এমন অনেক ঘটনাও ঘটে, একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত লোকের দাদা-দাদি বা নানা-নানি কারও ডায়াবেটিস ছিল না। কিন্তু তার বাবা-মা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল। সেই সব ক্ষেত্রেও কিন্তু সন্তানের ডায়াবেটিসকে বাবা-মায়ের ডায়াবেটিসের সাথে সম্পর্কিত করা হয়, কোনও কিছু বিবেচনা করা ছাড়াই। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, যে লোকের ডায়াবেটিসকে তার বাবার ডায়াবেটিস থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করা হয়, খুঁজে দেখা হয় না, তার বাবার ডায়াবেটিসও কি তার দাদা-দাদী কারও থেকে প্রাপ্ত?
তার বাবার ডায়াবেটিস যদি বংশগত কারণ ছাড়া অন্য কোনও কারণে হতে পারে, তার ডায়াবেটিসও কি সে রকম কোনও কারণে হতে পারে না? অবশ্যই পারে। তবু কেন শুধু শুধু মানুষের ডায়াবেটিসকে তার পূর্বপুরুষের ডায়াবেটিসের সাথে সম্পর্কিত করা হয়?
কারও ডায়াবেটিসকে তার পূর্বপুরুষের ডায়াবেটিসের সাথে সম্পর্কিত করার ক্ষতি কত মারাত্মক, তা জানলে যেকেউ অবাক হয়ে যাবে। ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করার কারণে দুই দিক থেকে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক. যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয় এবং যাদের বাবা-মা কারও ডায়াবেটিস ছিল না, তারা ভাবে, আমার বাবা-মা কারো যেহেতু ডায়াবেটিস ছিল না, আমিও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবো না। এটা ভেবে তারা ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কোনও উপায় অবলম্বন করে না। একসময় তারাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে ওই কারণে, যেই কারণে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। এভাবে তারা মারাত্মকভাবে বিভ্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুই. অপরদিকে যাদের বাবা-মা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, তারা ভাবে, যেহেতু আমার বাবা-মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, আমিও ডায়াবেটিসে অবশ্যই আক্রান্ত হবো।ডায়াবেটিস থেকে আমার রক্ষা পাবার কোনও সুযোগ নেই। এটা ভেবে তারাও হাত-পা ছেড়ে বসে থাকে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কোনও উপায় অবলম্বন করে না। এক সময় তারাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে ওই কারণে, সত্যিকারার্থে যে কারণে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
ডায়াবেটিস আক্রান্ত হবার সত্যিকারের কারণ কী? সত্যিকারের কারণ হলো কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকা, আরামপ্রিয় জীবন যাপন করা, শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া। এ জন্য আগে যখন মানুষের জীবনে পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম ছিল, তখন মানুষ ডায়াবেটিসে একেবারে কম আক্রান্ত হতো। কিন্তু এখন মানুষের জীবন থেকে দিন দিন কায়িক শ্রম দূরে সরে যাচ্ছে। তাই এখন মানুষ ব্যাপক হারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু এসবের মধ্যেও এখনও কিছু মানুষ নিয়মিত কায়িক শ্রম করছে বিভিন্নভাবে। দেখা যায়, তারা সহজে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। বিশেষ করে কায়িক শ্রমের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষগুলোকে দেখা যায়, বয়স অনেক বেশি হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না।
ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করার কারণে মানুষ আরও এক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ডায়াবেটিস যে কোনও বংশগত রোগ নয়, এখনও তার উদাহরণ দেওয়া যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের জীবন থেকে কায়িক শ্রম দিন দিন দূরে সরে যাবার কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার সমাজে যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, একটা সময় আসবে, যখন সবাই দেখবে, সবার বাবা-মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল। ডায়াবেটিস যে কোনও বংশগত রোগ নয়, তখন এই কথার পক্ষে কোনও বাস্তব উদাহরণ দেওয়া সম্ভব হবে না।
এখনও এটা প্রমাণ করার সুযোগ আছে, ডায়াবেটিস আরামপ্রিয় মানুষের রোগ। সময় থাকতে যদি ডায়াবেটিস সম্পর্কে ভুল বিশ্বাস প্রচার বন্ধ করে সঠিক বিশ্বাস প্রচার শুরু করা না হয়, ২-৩ দশক পর ‘ডায়াবেটিস বংশগত রোগ’, এই ভুল বিশ্বাস চূড়ান্তভাবে একটি সঠিক বিশ্বাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, সন্দেহ নেই। মূলত ডায়াবেটিস বংশগতভাবে হতে পারে ওইসব লোকের, যারা জন্মের আগে বা মাতৃদুগ্ধ পান শেষ হবার আগে তাদের বাবা-মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল। আর অন্য যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়, তারা সবাই আক্রান্ত হয় কায়িক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকার কারণে শরীরে চর্বি বেড়ে গিয়ে।তাই ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা পেতে হলে বাবা-মা কারও ছিল, কি ছিল না, তা না দেখে দেখতে হবে, আমি নিয়মিত পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করছি কিনা। যদি না করে থাকি, তাহলে ডায়াবেটিস আমাকে ধরবেই, কোনও রক্ষা নেই, যদি আরামে আরামেই জীবন কাটাই, আমার পূর্বপুরুষদের কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হয়ে থাকে, তবুও। পূর্বপুরুষদের অনেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেও সন্তান যতদিন নিয়মিত পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করবে, ততদিন ডায়াবেটিস থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম থেকে দূরে থাকলে ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার সুযোগ তেমন নেই।