নিয়মিত ব্যায়াম বা কায়িক শ্রমে ৮টি লাভ
নিয়মিত ব্যায়াম বা কায়িক শ্রমে ৮টি লাভ
আমরা অনেকেই জানি, সুস্থ জীবনের জন্য কায়িক শ্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা অনেকেই সুনির্দিষ্টভাবে জানি না, কায়িক শ্রম করলে কোন কোন রোগ থেকে নিরাপদ থাকা যায় এবং নিয়মিত কায়িক শ্রমে কী কী লাভ।
নিয়মিত কায়িক শ্রম করলে আপনি অনেক দিক থেকেই লাভবান হবেন।
রোগ থেকে নিরাপদ থাকার সুযোগ
(১) আপনি ঐসব রোগ থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত ও নিরাপদ থাকবেন, কায়িক শ্রম থেকে দূরের থাকার কারণে মানুষ যেই রোগগুলোতে বেশি বেশি আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক এবং কিডনী বিকলতা। অনেকে মনে করেন, কায়িক শ্রম থেকে দূরের থাকার কারণে মানুষ ব্রেইন স্ট্রোকেও আক্রান্ত হয়। ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার জন্যও কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকাকে দায়ী করতে দেখা যায়। হতে পারে। তবে আমার মনে হয় এটা নিশ্চিত নয়। এই বিষয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন। কিন্তু আপনি নিশ্চিতভাবে প্রথমে উল্লেখিত ৪টি রোগ থেকে নিরাপদ থাকবেন, যতোদিন নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে কায়িক শ্রম করবেন।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অটুট থাকা
(২) আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাবে না। নিয়মিত কায়িক শ্রম করার ফলে মানুষ জন্মগতভাবে যেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে, তা অটুট থাকে। বরং হয়তো আরো বেশি শক্তিশালী হয়। আর মানুষ কায়িক শ্রম থেকে দূরে সরে থাকলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পায়। মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। দেখা যায়, এখন অসংখ্য মানুষ, যারা কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকে, তারা অনেক রোগ নিয়ে জীবনযাপন করে। তাদের জীবন যাপন অনেক কঠিন। স্বাভাবিক জীবন যাপন থেকে তারা অনেক দূরে সরে যায়।
ফিটনেস ঠিক থাকা
(৩) শারীরিক ফিটনেস অটুট থাকে। অনেকে মনে করেন, বয়স বেশি হয়ে গেলে মানুষের কাজ করার শক্তি—সামর্থ এমনিতেই কমে যায়। মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। মানুষ অনেক কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। এইকথা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই কথা সত্য ঐসব মানুষের ক্ষেত্রে, যারা আরামে আরামে জীবন যাপন করে, যাদের জীবনে কায়িক শ্রম একেবারে কম।
কায়িক শ্রম থেকে দূরে দূরে থাকলে মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়, ওজন বেড়ে যায়, শরীর ভারী হয়ে যায়। যার ফলে মানুষ দিন দিন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। অল্প পরিশ্রমেই মানুষ কাতর হয়ে পড়ে, হাঁপিয়ে ওঠে। এই নিস্তেজ হবার সাথে বা হাঁপিয়ে ওঠার সাথে বয়স বেশি হবার সম্পর্ক তেমন নেই, সম্পর্ক হচ্ছে শরীরে মেদ—চর্বি জমা হয়ে যাবার সাথে।
এই জন্য দেখবেন, যারা নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে কায়িক শ্রম করে, তারা অনেক বয়সেও ফিট থাকে। সুস্থ সবল থাকে। সমাজে বিভিন্ন কায়িক শ্রমের পেশায় নিযুক্ত মানুষদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখবেন, তাদের অনেকের বয়স ৬০—৭০ বছর হয়ে যাবার পরও তারা শারীরিকভাবে অনেক সবল ও শক্তিশালী। শারীরিক পরিশ্রমের অনেক কঠিন কাজও তারা অনায়াসে করতে পারে।
বেশি দিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি
(৪) বেশি দিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত কায়িক শ্রমে নিযুক্ত মানুষ দীর্ঘজীবি হয় বেশি। পৃথিবীতে তুলনামূলক বেশি দিন বেঁচে থাকে। মানুষ যতোদিন কায়িক শ্রম করে, ততোদিন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, কিডনী বিকলতা এইসব রোগ থেকে নিরাপদ থাকার কারণে তারা অন্যদের তুলনায় বেশি দিন বেঁচে থাকে। দেখবেন, সমাজে মানুষ এখন এই রোগগুলোতেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। ৫০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ এখন খুব কম পাওয়া যায়, যারা এই তিনটি রোগের কোনো একটি বা একাধিকটিতে আক্রান্ত নয়। কিন্তু যারা নিয়মিত কায়িক শ্রম করে, তারা ৬০—৭০ বছর বয়সে এসেও এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকে। এভাবেই কায়িক শ্রমের ফলেই মানুষ তুলনামূলক বেশি দিন বেঁচে থাকার সুযোগ পায়।
ডাক্তারের কাছে কম যেতে হওয়া
(৫) ডাক্তারের কাছে যেতে হয় কম। যারা কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকে, আরামে আরামে জীবন যাপন করে, তাদের শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধে, যার ফলে তাদেরকে বেশি বেশি ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। আর যারা নিয়মিত কায়িক শ্রম করে, তারা রোগব্যাধিতে খুব কম আক্রান্ত হয় বলে ডাক্তারের কাছে তেমন যেতে হয় না।
আর ডাক্তারের কাছে যাওয়া—আসা সব সময় বিরক্তিকর। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। এখানে ডাক্তারের সাথে দেখা করতে সিরিয়ালে দাঁড়াতে হয়, পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য আবারও সিরিয়াল, এরপর টেস্টের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা এবং আবারও ডাক্তারের কাছে গিয়ে রিপোর্ট দেখানো। এই বিড়ম্বনাগুলো সম্পর্কে আমরা সবাই কম বেশি অবগত। নিয়মিত কায়িক শ্রমে লিপ্ত মানুষ এই বিড়ম্বনাগুলো থেকে দূরে থাকে বেশি।
চিকিৎসার পেছনে কম খরচ হওয়া
(৬) চিকিৎসা ব্যয় কম। কায়িক শ্রমে লিপ্ত মানুষ রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকার কারণে তার চিকিৎসা ব্যয়ও অনেক কম হয়। আমরা প্রায় সবাই জানি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনী বিকলতা এই সব রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ব্যয় কত বেশি। চিকিৎসার পেছনেই এদেরকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়। ‘বাংলাদেশে ডায়াবেটিস: রোগীর পেছনে বছরে খরচ কত?’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় ২১ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশনের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ।
একজন রোগীর যদি প্রতিমাসে গড়ে দুই হাজার টাকা খরচ হয়, তাহলে সে হিসেবে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা বাবদ প্রতিমাসে বাংলাদেশে খরচ হচ্ছে প্রতি মাসে ১৪ শত কোটি টাকা এবং প্রতি বছরে খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
চিকিৎসকরা বলেন, ডায়াবেটিস অন্য আরো নানা ধরনের রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে চিকিৎসা ব্যয় বাড়তেই থাকে।’’
‘হৃদরোগের সব চিকিৎসাই ব্যয় বহুল’ শিরোনামে বাংলা ইনসাইডারে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে প্রকাশিত অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ’র সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘একবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে সারতে অনেক সময় লাগে। অনেকের সারা জীবন চিকিৎসা চালিয়ে নিয়ে যেতে হয়। হৃদরোগের চিকিৎসাও অনেক ব্যয় সাপেক্ষ। নিম্ন মধ্যবিত্ত, গরিব মানুষদের এ রোগের ব্যয়নির্বাহ করতে বেশ হিমশিম খেতে হয়। প্রাথমিকভাবে ওষুধপত্র দিয়ে হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় পরবর্তীতে হার্টে ব্লক ধরা পড়লে রিং পরাতে হয়, বাইপাস করতে হয়। হৃদরোগের সব চিকিৎসাই ব্যয় সাপেক্ষ।’’
‘কিডনি রোগী এক বছরে বেড়ে দ্বিগুণ, চিকিৎসার খরচ এতো বেশি কেন’ শিরোনামে বিবিসি নিউজ বাংলায় ৯ মার্চ ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ ধরা পড়লে ওষুধ ও নিয়ম শৃঙ্খলার মাধ্যমে আগে অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
তবে কিডনি যদি অকেজো হয়ে যায় তাহলে কিডনি প্রতিস্থাপন ও ডায়ালিসিস ছাড়া বাঁচার উপায় থাকে না, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এই দুটি চিকিৎসা পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল।’’
এভাবে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষকেও সার্বক্ষণিক ডাক্তার দেখাতে হয় এবং নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ খেতে হয়।
এই রোগগুলোতে যারা আক্রান্ত নয়, তারা চিকিৎসা সংক্রান্ত এই সব খরচ থেকে বেঁচে যায়। আর কায়িক শ্রমে নিয়মিত মানুষরাই এই রোগগুলো থেকে বেশি নিরাপদ থাকে।
খাবার খেতে বাছতে না হওয়া
(৭) খাবার খেতে বাছবিচার করতে হয় না। যে কোনো খাবার খেতে পারে। যারা নিয়মিত কায়িক শ্রম করে, তারা যে খাবারই খায় না কেন, তা তাদের শরীরে কোনো রোগ সৃষ্টি করতে পারে না। কারণ নিয়মিত এনার্জি বার্ন করার ফলে তাদের শরীরে কোরেস্টেরল জমা হতে পারে না। তারা বেশি শর্করাজাতীয় খাবার খেলেও, বেশি ক্যালরীযুক্ত খাবার খেলেও সেগুলোর কোনো ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি তারা হয় না। তারা পছন্দের যে কোনো খাবার খেতে পারে নিশ্চিন্তে। অথচ কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকা মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার কারণে রোগের তীব্রতা থেকে বাঁচতে পছন্দের অনেক খাবার বর্জন করতে হয়। জীবন হয়ে যায় নিরামিষ, বিস্বাদ।
ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন কম হওয়া
(৮) জীবন নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ কম থাকে। যারা নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে কায়িক শ্রম করে, তারা শারীরিকভাবে অনেক সবল এবং সুস্থ থাকে বলে ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশায় ভোগে না। কিন্তু যারা কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকে, তারা নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগে সব সময়। কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকার ফলে মানুষ যেসব রোগে আক্রান্ত হয়, সেগুলোর প্রায় সবগুলোই নিরাময় অযোগ্য রোগ। রোগগুলোতে মানুষ একবার আক্রান্ত হলে বাকি জীবন রোগগুলো বয়ে বেড়াতে হয়, কোনোভাবে রোগগুলো থেকে মুক্তি পায় না। এটাই হচ্ছে রোগগুলোতে আক্রান্ত মানুষের দুশ্চিন্তার একটি বড় কারণ।
যারা এখনো উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক (হৃদরোগ), কিডনী বিকলতা এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হননি, তারা যদি উপরের লাভগুলো পেতে চান, সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক জীবন যাপনের সম্ভাবনা বাড়াতে চান, নিয়মিত অন্তত ৪০ মিনিট করে ঘাম ঝরানো কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করুন। এই লাভগুলো আপনার সঙ্গী হবে।
নূর আহমদ
ফিটনেস বিষয়ক গবেষক ও লেখক