লবণ খেলে কি উচ্চ রক্তচাপ হয়?
লবণ খেলে কি উচ্চ রক্তচাপ হয়?
উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার এখন এক মহা সমস্যার নাম। ৫০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের অধিকাংশই এখন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। সমাজের প্রায় প্রতি ঘরেই এখন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষ পাওয়া যায়। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হলে মানুষের জীবন অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। যখন—তখন রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে মানুষ অস্থির হয়ে পড়ে। অনেক সময় রক্তচাপ কমে গিয়ে মানুষের শরীর বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে, মানুষ মাথা চক্কর দিয়ে ঘুরে পড়ে যায়। শরীরে দেখা দেয় অশান্তি। সবচেয়ে বড় কথা, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ না করলে আরো কিছু মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক এবং ডায়াবেটিস। আপনি দেখবেন, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার আগে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ছিল। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষরাই হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে, ডাক্তারের কাছে নেয়ার সুযোগ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। ভাগ্য সহায় থাকলে কেউ কেউ ডাক্তারের কাছে নেয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকে এবং চিকিৎসার সুযোগ পায়। তবে হার্ট অ্যাটাকে একবার আক্রান্ত হলে মানুষ হৃদরোগী হয়ে যান বাকি জীবনের জন্য। এই ধরনের মানুষ অনেক ক্ষেত্রে পুণরায় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েই মারা যান।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, উচ্চ রক্তচাপের কারণ নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আছে। শুধু সাধারণ মানুষ নন, অনেক ডাক্তারও মনে করেন, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার একটি প্রধান কারণ লবণ খাওয়া।
আমরা অনেকেই বিষয়টা জানি। তাই উচ্চ রক্তচাপ থেকে বাঁচতে অনেকে খাবারের সাথে লবণ খায় না।
লবণ খেলে কি সত্যিই উচ্চ রক্তচাপ হয়?
এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে দেখা দরকার, সমাজের কোন শ্রেণির মানুষ বেশি বেশি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়, আর কোন শ্রেণির মানুষ উচ্চ রক্তচাপে কুব কম আক্রান্ত হয়।
যে কেউ তার চারপাশের মানুষগুলোর দিকে একটু চোখ বুলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে, যেসব মানুষ নিয়মিত ঘাম ঝরানো কায়িক শ্রম করে, যেমন: কায়িক শ্রমের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষ, সামরিক বাহিনীতে কর্মরত যেসব মানুষ নিয়মিত রুটিন মাফিক ব্যায়াম করে, কায়িক শ্রম নির্ভর বিভিন্ন খেলা, যেমন: ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, টেনিস ইত্যাদি খেলা যারা পেশাদারভাবে খেলে যাচ্ছেন অনেক বছর ধরে, এই সব মানুষ উচ্চ রক্তচাপ থেকে একেবারে নিরাপদ থাকে। অথচ এদের অনেকের বয়স ৫০—৬০ বছরেরও বেশি।
আমি এসব প্রসঙ্গে প্রায়ই পায়েচালিত রিকশা চালকদের উদাহরণ দিয়ে থাকি। ঢাকা শহরে এখনো পায়েচালিত রিকশার প্রচলন রয়েছে। যারা ঢাকা শহরে থাকেন, তারা যদি ২০ জনের বেশি পায়েচালিত রিকশা চালকের খোঁজ নেন, যারা অনেক বছর ধরে রিকশা চালাচ্ছেন, মাঝখানে লম্বা কোনো বিরতি দেয়া ছাড়াই, তাদের মধ্যে দুইটা জিনিস দেখবেন। (১) তাদের কেউই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত নয়। অথচ তাদের অনেকের বয়স ৬০ বছরের বেশি হয়ে গেছে। (২) তাদের মধ্যে অধিকাংশ রিকশা চালকই খাবারের সাথে লবণ খেয়ে থাকেন।
আরো পড়ুন: নিয়মিত ব্যায়াম বা কায়িক শ্রমে ৮টি লাভ
সমাজের যেই মানুষগুলো এখনো কায়িক শ্রমের বিভিন্ন পেশায় কর্মরত, দেখবেন তাদের মধ্যেও এই দুইটা জিনিস পাওয়া যাবে। তাদের প্রায় সবাই উচ্চ রক্তচাপ থেকে মুক্ত এবং তাদের অনেকেই খাবারের সাথে লবণ খেয়ে থাকেন নিয়মিত। যদি লবণ খেলে উচ্চ রক্তচাপ হয়, তাহলে অনেক বছর ধরে কায়িক শ্রমে লিপ্ত মানুষ নিয়মিত লবণ খাওয়া সত্ত্বেও কেন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয় না?
আমার এক বন্ধু আছে। সে খাবারের সাথে লবণ খায় না। তবু কয়েক বছর আগে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। সে একদিন আমাকে বলেছেও বিষয়টা। বলেছে, আমি লবণ খাই না, তবু কেন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হলাম? আমি তাকে বলেছি, আপনি লবণ না খেলে কী হবে, আপনার জীবন চলার পথে তেমন কায়িক শ্রম হয় না বলেই আপনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছেন।
আমার বাবা মা উভয়ে আগে যখন নিয়মিত সাংসারিক বিভিন্ন কায়িক শ্রমে লিপ্ত থাকতেন, তখন তাদের কেউ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হননি। কিন্তু কয়েক বছর আগে যখন সাংসারিক কাজকর্ম থেকে অবসরে চলে যান, অবসরে চলে যাবার অল্প কয়েক বছরের মধ্যে তারা উভয়ে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
আপনি পরিসংখ্যান দেখুন। দেখবেন, আজ থেকে ৫০—৬০ বছর আগে মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হতো একেবারে কম। কিন্তু এখন ব্যাপকাহারে আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষ কি আগে খাবারের সাথে লবণ খেতো না? এখন বেশি বেশি লবণ খাচ্ছে? বিষয়টা এই রকম নয়। আমরা সবাই জানি, আগে মানুষের জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে কায়িক শ্রম ছিল। কিন্তু এখন মানুষের জীবনে কায়িক শ্রম অনেক কম। অনেক মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে কায়িক শ্রম একেবারে নেই বললেই চলে। আগে কায়িক শ্রমের আধিক্যের কারণেই মানুষ উচ্চ রক্তচাপে তেমন আক্রান্ত হতো না। আর এখন কায়িক শ্রম অনেক কমে যাবার কারণে, মানুষ আরামপ্রিয় জীবন যাপন করার কারণেই বেশি বেশি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হচ্ছে।
আমি নিজে এখনো উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হইনি। অথচ আমার পরিচিত আমার চেয়ে কম বয়সী অনেক মানুষ আরো আগেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছেন।
আমি কেন এখনো উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হইনি? শুধুই কায়িক শ্রমের চর্চা করার কারণে। আর আমার পরিচিত যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের জীবনে কায়িক শ্রম নেই বললেই চলে।
শুধু কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকলেই মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়। লবণ খাওয়া বাদ দিয়ে কোনো লাভ নেই।
লবণ খেতে আপনার ভালো না লাগলে আপনি লবণ খাওয়া বাদ দিতে পারেন। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য লবণ খাওয়া বাদ দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আপনি যদি কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকেন, আরামে থাকতেই পছন্দ করেন, উচ্চ রক্তচাপ আপনাকে ছাড়বে না।
তাই উচ্চ রক্তচাপ থেকে বাঁচার জন্য লবণ খাওয়াকে নয়, বরং সারাক্ষণ আরামে থাকাকে বাদ দিন। দৈনিক অন্তত ৪০ মিনিট করে ঘাম ঝরানো কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করুন। আপনি উচ্চ রক্তচাপ থেকে শুধু নয়, একই সাথে ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাক থেকেও নিশ্চিতভাবে নিরাপদ থাকবেন।
নূর আহমদ