মিষ্টি খেলে কি সত্যিই ডায়াবেটিস হয়?
মিষ্টি খেলে কি সত্যিই ডায়াবেটিস হয়?
বিগত কয়েক দশক ধরে ডায়াবেটিস ব্যাপক হারে মানুষকে আক্রমণ করছে। আগে সাধারণত বয়স্ক মানুষদের কেউ কেউ শেষ বয়সে এসে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো। কিন্তু এখন মধ্যবয়সী এবং তরুণ প্রজন্মও ব্যাপক হারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেক শিশুও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে।
ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে মানুষ এখন খুব বেশি কৌতুহলী। ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে সমাজে অনেক কথা প্রচলিত হয়ে গেছে। তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, মিষ্টি খেলে নাকি ডায়াবেটিস হয়। মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এটা বিশ্বব্যাপী বহুল প্রচলিত একটি বিশ্বাস। কথাটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ভয়ে অনেক মানুষ মিষ্টি বা চিনি খাওয়া পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিয়েছে।
আমি নিজেও অনেক মানুষকে মিষ্টি খাওয়া থেকে দূরে থাকতে দেখেছি। এসব মানুষকে জিজ্ঞেস করলে বলে, মিষ্টি খেলে নাকি ডায়াবেটিস হয়। তাই তারা মিষ্টি খাচ্ছে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, মিষ্টি খেলে কি সত্যিই ডায়াবেটিস হয়? আমরা আজ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো।
শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিগত কয়েক দশক ধরে ডায়াবেটিস ব্যাপক হারে মানুষকে আক্রমণ করছে। আগে মানুষের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার হার অনেক কম ছিল।
আগের মানুষ নিয়মিত বেশি বেশি কায়িক শ্রম করতো
আমাদের যাদের বয়স ৫০ বছর বা এর চেয়ে বেশি, আমরা ছোটবেলায় তিনটি বিষয় দেখেছি। (১) আমাদের ছোটবেলায় সমাজের প্রায় সব মানুষ বিভিন্ন ভাবে কায়িক শ্রম করতো। কায়িক শ্রম ছাড়া মানুষের পক্ষে একটা দিন কাটানোরও সুযোগ ছিল না। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে জীবন চলার পথে প্রায় প্রতিটা পদক্ষেপে মানুষকে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রচুর কায়িক শ্রম করতে হতো। (২) মানুষ তখন ডায়াবেটিসে খুব কম আক্রান্ত হতো। মধ্যবয়সী, তরুণ বা শিশুরা তখন ভুলেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো না। শুধু যেসব বয়স্ক মানুষ শেষ বয়সে এসে সাংসারিক কাজকর্ম থেকে পুরোপুরি অবসরে চলে যেতো, তাদের কেউ কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো। (৩) যেহেতু তখন ডায়াবেটিস রোগটি মানুষের একেবারে কম হতো, তখন মিষ্টি খেলে, নাকি অন্য কিছু খেলে মানুষের ডায়াবেটিস হয়, এই ধরনের ভয় কারো মনে ছিল না। মানুষ মিষ্টি বা মিষ্টান্ন খেতে মোটেই দ্বিধা করতো না।
বিগত কয়েক বছরে যা হয়েছে
কিন্তু বিগত কয়েক ধরে আমরা ভিন্ন তিনটি বিষয় দেখি। (১) মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে কায়িক শ্রম অনেক অনেক কমে গেছে। জীবনের অনেক ক্ষেত্রে আরামদায়ক প্রযুক্তির উদ্ভব হয়েছে। অসংখ্য মানুষ এখন ২৪ ঘন্টা আরামে থাকার সুযোগ পাচ্ছে। খুব কম মানুষ এখন কায়িক শ্রমের সাথে যুক্ত। (২) শুধু বয়স্করা নয়, মধ্যবয়সী, তরুণ এবং শিশুরাও এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ এবং মধ্যবয়সী মানুষদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস মহামারী রূপ ধারণ করেছে। (৩) অনেক মানুষ এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ভয়ে মিষ্টি বা মিষ্টান্ন খাওয়া বাদ দিচ্ছে।
আগের তিনটা বিষয় এবং এখনকার তিনটা বিষয় নিয়ে একটু মাথা ঘামালে সহজেই সবার নিকট স্পষ্ট হবে, কেন আগে মানুষ ডায়াবেটিসে একেবারে কম আক্রান্ত হতো আর এখন ডায়াবেটিস মানুষকে ব্যাপক হারে আক্রমণ করছে।
আগের মানুষ ডায়াবেটিসে তেমন আক্রান্ত হতো না কেন?
হ্যাঁ, শুধু আগের মানুষ বেশি বেশি কায়িক শ্রমে লিপ্ত থাকার কারণেই ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকতো, যতোদিন কায়িক শ্রম করতো। কিন্তু এখন কায়িক শ্রম থেকে দূরে সরে যাবার কারণেই, মানুষের জীবন থেকে কায়িক শ্রম অনেকটা উধাও হয়ে যাবার কারণেই মানুষ ব্যাপকহারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। মিষ্টি খাওয়া বাদ দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। কারণ মিষ্টি খাওয়ার সাথে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কোনো সম্পর্কই নেই।
কায়িক শ্রমে লিপ্ত মানুষের দিকে লক্ষ্য করুন
বিষয়টা আরো পরিষ্কারভাবে বুঝার জন্য যদি আমরা এখনও সমাজের যেই অল্প সংখ্যক মানুষ কায়িক শ্রমে লিপ্ত আছেন, তাদের দিকে লক্ষ্য করি, আমরা দেখবো, ২০ বছরের বেশি সময় ধরে কায়িক শ্রমের কোনো পেশায় লিপ্ত মানুষরা বয়স অনেক বেশি হয়ে যাবার পরও ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ আছেন। আমার পরিচিত ৬০ বছরের বেশি একজন মানুষকে আমি কিছুদিন আগে প্রসঙ্গক্রমে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কি ডায়াবেটিস আছে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘ডায়াবেটিস আবার কী?’ আমি অনেকটা হতবাক হয়ে গেলাম। লোকটি নিয়মিত কায়িক শ্রম করে। এভাবে আমার পরিচিত যেসব মানুষ নিয়মিত কায়িক শ্রম করে, আমি দেখেছি, তাদের কেউই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয়।
অন্যদিকে আমার পরিচিত যেসব মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তারা কেউই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার আগে কায়িক শ্রমের সাথে তেমন একটা সম্পর্ক রাখতো না, আরামেই থাকতো বেশি।
আপনিও যদি আপনার পরিচিত কায়িক শ্রমের বিভিন্ন পেশায় অনেক বছর ধরে লিপ্ত মানুষদের খোঁজ নেন, দেখবেন, তাদের প্রায় সবাই ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কারণ সম্পর্কে কিছু ভুল বিশ্বাস
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার জন্য টেনশনকে দায়ী করা হয়, বংশগত বিষয়কে দায়ী করা হয়, বয়স বেশি হওয়াকে দায়ী করা হয়, ধূমপানকেও দায়ী করতে দেখা যায়। এই সব কোনো কিছুর সাথে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কোনো সম্পর্ক যে নেই, তা বুঝা যায় কায়িক শ্রমে লিপ্ত মানুষের ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকা দেখে। কারণ এসব মানুষের মধ্যে উপরের প্রায় সবগুলো কারণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও এরা ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকার অর্থই হচ্ছে, এগুলো ডায়াবেটিসের কোনো কারণ নয়। বরং ডায়াবেটিসের সত্যিকারের কারণ হচ্ছে, আরামে জীবন যাপন করা, কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকা, শরীরে কোলেস্টেরল বৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়া। ডায়াবেটিস মূলত একটি আরামপ্রিয় মানুষের রোগ।
আমি নিজেও মিষ্টি খেতে পছন্দ করি
আমি নিজে মিষ্টি খেতে পছন্দ করি। মিষ্টি খেতে কখনো দ্বিধা করি না। তবু ডায়াবেটিস আমাকে এখনো আক্রমণ করতে পারেনি, কারণ আমরা জীবনে নিয়মিত পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম আছে। আমার বাবা—মাও আগে মিষ্টি খেতেন নির্দ্বিধায়, কিন্তু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হননি, যতোদিন কায়িক শ্রমে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে কায়িক শ্রম ছেড়ে দেয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই তারা উভয়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। এখন কষ্টকর জীবন পার করছেন। মনমতো খেতে পারছেন না। নিয়ম করে ঔষধ খেতে হচ্ছে, অনেক খাবার থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে ইত্যাদি।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সাথে কায়িক শ্রম না করাই সম্পর্কিত
আমিও যদি কখনো কায়িক শ্রম ছেড়ে দিই, আরামে থাকতে শুরু করি, ডায়াবেটিস আমাকেও আক্রমণ করবে। তখন মিষ্টি খাওয়া বাদ দিয়েও লাভ হবে না। কারণ মিষ্টি খাওয়ার সাথে নয়, বরং কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকার সাথেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্পর্ক।
ডায়াবেটিসের সাথে মিষ্টি খাওয়ার সম্পর্ক
ডায়াবেটিস হয়ে গেলে মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। তাই বলে মিষ্টি খেলেই ডায়াবেটিস হবে, এমন কোনো কথা নেই। ইলিশ, চিংড়ি, গরুর মাংস এসব খেলে কখনো এলার্জি হয় না, কিন্তু যাদের এলার্জি আছে, তারা এসব খেলে তাদের এলার্জি বেড়ে যায়। দুটো বিষয় একই রকম।
ডায়াবেটিস থেকে বাঁচতে চাইলে
আপনি যদি ডায়াবেটিস থেকে বাঁচতে চান, নিয়মিত অন্তত ৪০ মিনিট কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করুন। মিষ্টি বেশি খেলেও আপনার কিছুই হবে না।