বেশি দিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়াবেন যেভাবে

বেশি দিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়াবেন যেভাবে

নূর আহমদ

পৃথিবীতে মানুষ মাত্র একবারের জন্যই আসে। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ছাড়া প্রায় সব মানুষ পৃথিবীতে যতো বেশি দিন সম্ভব, বেঁচে থাকতে চায়। এর কারণ পৃথিবী একটি মোহনীয় এবং উপভোগ্য জায়গা। এখানে উপভোগের উপকরণ এবং অনুষঙ্গের অভাব নেই।

কিন্তু পৃথিবীতে বেশি দিন বেঁচে থাকতে চেয়েও অনেক মানুষ হঠাৎ করে বা অসময়ে মৃত্যুবরণ করে। পৃথিবীতে বেশি দিন বেঁচে থাকা বা দীর্ঘজীবন লাভের সূত্র বা উপায় নিয়ে গবেষণা অনেক হয়েছে। এই বিষয়ে অনেক বইও লেখা হয়েছে।

দীর্ঘ জীবন লাভের উপায়


আমি নিজেও অনেক লেখা পড়েছি দীর্ঘজীবন লাভের উপায় নিয়ে। আমি যখন এই বিষয় নিয়ে ভাবতে বা অধ্যয়ন করতে শুরু করিনি, তখন প্রচলিত মতামতগুলোকেই বি্বিাস করতাম। বেশি দিন বেঁচে থাকার উপায় নিয়ে প্রচলিত বিশ্বাসগুলোগুলো হচ্ছে, বেশি হাসিখুশি থাকা, মানসিক চাপমুক্ত থাকা, তাজা ফলমূল বেশি খাওয়া, নিরামিষ খাবার বেশি খাওয়া, ধূমপান না করা, অতিরিক্ত ক্যালরীযুক্ত খাবার বা কাবোর্হাইড্রেট এড়িয়ে চলা ইত্যাদি।

দীর্ঘজীবন লাভের উপায় নিয়ে আপনি গুগলে খুঁজলে অনেক নিবন্ধ পাবেন। নিবন্ধগুলোর কোনোটিতে দীর্ঘজীবন লাভের ৭টি উপায় উল্লেখ করা হয়েছে, কোনোটিতে ১৫টি গোপন কৌশল উল্লেখ করা হয়েছে, কোনোটিতে ৫টি কার্যকরী উপায় উল্লেখ করা হয়েছে আবার কোনোটিতে ১৩টি বৈজ্ঞানিক উপায়ের উল্লেখ করা হয়েছে। আপনি কোন নিবন্ধে উল্লেখিত উপায় অনুসরণ করবেন? নাকি সবগুলো নিবন্ধে উল্লেখিত সবগুলো উপায় অনুসরণ করবেন? সত্যিকারার্থে দীর্ঘজীবন লাভের কয়টি উপায় আছে?

আমি আপনাকে মাত্র ৩টি উপায় অবলম্বন করার পরামর্শ দেবো। ওই ৩টি উপায় হচ্ছে (১) নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘাম ঝরানো কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করা, যাকে ইংরেজিতে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি বলা হয়। (২) বেশি খাওয়ার পরিবর্তে সব সময় কম খাওয়া। (৩) ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।

আপনি এই তিনটি উপায় অবলম্বন করলে আপনাকে আর কোনো দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে না। আপনাকে সবসময় হাসিখুশি থাকতে হবে না, যা সবার পক্ষে সব সময় সম্ভবও নয়। মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকার দরকার হবে না। মানসিক চাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখাও সবার পক্ষে সম্ভব নয়। যারা নিয়ীমত পর্যাপ্ত পরিমাণে কায়িক শ্রম করে, তাদের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে না পারার ফলে তারা অনেক রোগ থেকে নিরাপদ থাকে। ক্যালরী মেপে মেপে খাবার খাওয়ারও প্রয়োজন হবে না। কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা পরিহার করা নিয়ে ভাবতে হবে না। এর কারণ মানুষ যা—ই খায়, নিয়মিত পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম করার কারণে এনার্জি বার্ন হয়ে যায়। কোনো খাবারে মানুষের কোনো ক্ষতি হয় না। ধূমপান পরিহার নিয়েও ভাবতে হবে না। ধূমপানে মানুষ কোনো রোগে আক্রান্ত হয় না। যদিও সারা বিশে^ই বিশ^াস করা হয়, ধূমপানে ক্যান্সার, ব্রেইন স্ট্রোক এসব রোগ হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ধূমপানে কোনো রোগই হয় না। আপনি দেখবেন, পৃথিবীব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ ৩০—৪০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে দৈনিক ২০টির বেশি সিগারেট খাওয়া সত্ত্বেও ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াই বিদায় নেয়ার সুযোগ পায়। ধূমপানে এসব রোগ হলে এমনটা কখনোই হতো না। এছাড়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপানের সাথে সম্পর্ক না রাখা সত্ত্বেও অসংখ্য মানুষ এই দুইটি রোগে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশের অসংখ্য মহিলা এবং মাদ্রাসা শিক্ষিত মানুষের ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ‘‘সুস্থ শরীরে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার উপায়’’ শিরোনামে জার্মানীর ডয়চেভেলের ওয়েবসাইটে ২৫ এপ্রিল ২০২২ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ‘‘নিউইয়র্কের আলবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিন ইন্সটিটিউট অব এজিং রিসার্চ বিভাগের প্রধান ড. নীর বারসিলাই দীর্ঘ জীবন পাওয়া মানুষদের নিয়ে কাজ করেন। তবে সব দীর্ঘজীবী নয়, তার কাজ শুধু শতায়ুদের নিয়ে। আপাতত ৭৫০ জন শতায়ুকে নিয়ে কাজ করে মানুষের সুস্থ দীর্ঘজীবন যাপনের উপায় খুঁজছেন বারসিলাই। গত প্রায় ২০ বছর ধরে শতায়ুদের নিয়ে কাজ করছেন ড. বারসিলাই। এই দুই দশকের অভিজ্ঞতায় তিনি জেনেছেন, শতায়ু যে শুধু অধুমপায়ীরাই হন, তা ঠিক নয়। এমনকি সারাজীবন নিরামিষ খেয়েছেন যারা, তাদেরও অতি নগণ্য অংশই শতায়ু হয়েছেন।’’

দীর্ঘজীবন লাভের সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য এই তিনটি উপায়ের পরিবর্তে যদি কেউ বলে তাঁকে শুধু একটি উপায় বলে দিতে। আমি বলবো, এই তিনটি উপায়ের পরিবর্তে যদি কেউ শুধু একটি উপায় অবলম্বন করতে চায়, সে শুধু নিয়মিত পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম করলেই হবে। বাকি দুইটি না করলেও চলবে। কারণ যেকোনো মানুষ যদি নিয়মিত পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম করে, সে বেশি খেলেও, সে স্থ’ূল হলেও তার এনার্জি বার্ন হয়ে যাবার কারণে তার শরীরে কোলেস্টেরল জমা হতে পারে না বলে সে অনেকগুলো রোগ থেকে নিরাপদ থাকে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, কিডনী বিকলতা ইত্যাদি।

বর্তমান বিশ্বে মানুষ এখন এই রোগগুলোতেই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। এই রোগগুলোর কারণে অকালমৃত্যুও বেশি ঘটছে। তাই যদি কেউ নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে কায়িক শ্রম করে, সে এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকার মাধ্যমে তার অকালমৃত্যু হাবার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে এবং তার দীর্ঘ জীবন লাভের সম্ভাবনা বাড়বে। এভাবেই শুধু নিয়মিত পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম করার মাধ্যমে মানুষ বেশি দিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়াতে পারে।

এবার একটি মজার বিষয় জেনে নেয়া যাক। দীর্ঘজীবন লাভের উপায় নিয়ে আপনি যতো নিবন্ধ পড়বেন, যেই নিবন্ধে যতো উপায়ের কথাই উল্লেখ থাকুক, নিয়মিত কায়িক শ্রম করার কথা সব নিবন্ধে খুঁজে পাবেন। কোনো নিবন্ধেই দেখবেন এই উপায়টি বাদ যায়নি। এটাই দীর্ঘজীবন লাভের মূল উপায়। যদি এর পাশাপাশি আপনি কম কম খেতে পারেন এবং স্থ’ূলতা প্রতিরোধ করতে পারেন, তাহলে আপনার দীর্ঘ জীবন লাভের সম্ভাবনা আরো শক্তিশালী হবে। দীর্ঘজীবন লাভের সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য আপনাকে আর তেমন কিছুই করতে হবে না। শুধু নিয়মিত পর্যাপ্ত ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটিই যথেষ্ট। এবার একটি প্রতিবেদন দেখুন।

‘‘আজারবাইজানের লেরিকে দীর্ঘজীবীদের জাদুঘর’’ শিরোনামে দৈনিক দেশ রূপান্তরে ২১ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত দীর্ঘ প্রতিবেদনটি পড়া শুরু করার পর যখন দেখলাম, সেখানে দীর্ঘজীবিদের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে কায়িক শ্রম ব্যতীত অন্য অনেক কিছু উল্লেখ করতে করতে নিবন্ধটি শেষ হয়ে যাচ্ছে, তখন কিছুটা অবাক হলাম। কিন্তু একেবারে শেষের দিকে দেখলাম, ঠিকঠাকভাবেই কায়িক শ্রমের কথাটা গুরুত্বসহকারে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। নিবন্ধটিতে বলা হয়, ‘লেরিক গ্রামটি খুব শান্ত। গ্রামের মানুষের শারীরিক কাজকর্ম গ্রামে সব সময় চাঞ্চল্য ধরে রাখে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তারা নিজ বাড়ির বাগানে অথবা মাঠে কাজ করে। খাবার নিয়ে সচেতনতা মেনে চলা এমন নয়, তারা নিজেদের পরিশ্রম করে ফলানো ফসল, ফলমূল খেয়ে জীবনযাপন করতেই বেশি ভালোবাসেন। মাঠে নিয়মিত কাজ, প্রচুর পানি পান, পুষ্টিকর খাবারেই তারা অভ্যস্ত।’’


আপনি কিভাবে কায়িক শ্রম করবেন বা কোন ব্যায়ামটি করবেন? আপনি যে কোনোভাবেই কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করতে পারেন। হতে পারে কৃষিক্ষেতে কাজ, হতে পারে কায়িক শ্রম নির্ভর খেলাধুলা, হতে পারে জিমে ব্যায়াম করা। আপনি যেই কায়িক শ্রমই করেন, তা অবশ্যই হতে হবে ঘাম ঝরানো এবং নিয়মিত ৪০ মিনিটের মতো। কায়িক শ্রম বা ব্যায়ামের উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে জোরে জোরে হাঁটা। সবচেয়ে সহজ এবং নিরাপদ ব্যায়ামও হচ্ছে হাঁটা। এটি কম পরিশ্রমে উপযুক্ত একটি ব্যায়াম, যা সব বয়সের মানুষের জন্য প্রযোজ্য।

বেশিদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়াতে চাইলে আরো দুইটি দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মদপান এড়িয়ে চলতে হবে এবং দুর্ঘটনার সম্ভাবনা আছে, এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।

নূর আহমদ

ফিটনেস বিষয়ক গবেষক ও লেখক

ইউটিউব চ্যানেল: https://www.youtube.com/@FitnessNurAhmed


Next Post Previous Post