কিডনি বিকল হয় কেন? ব্যথার ওষুধ বেশি খেলে কি কিডনি বিকল হয়ে যায়? কিডনি বিকলতা প্রতিরোধের উপায়
কিডনি বিকল হয় কেন? ব্যথার ওষুধ বেশি খেলে কি কিডনি বিকল হয়ে যায়? কিডনি বিকলতা প্রতিরোধের উপায়
নূর আহমদ
কিডনি মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। শরীরের সব ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থগুলো কিডনির মাধ্যমে পরিস্রুত হয়। কিডনির অসুস্থতা মানুষের শরীরের ওপর বিশাল বিপর্যয় ডেকে আনে। কিডনি বিকলতা এখন একটা খুব পরিচিত রোগ। রোগটিতে অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের পরিচিত বা কাছের কোনো কোনো মানুষকেও রোগটিতে আমরা আক্রান্ত হতে বা রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে দেখি। এই জন্য কিডনি বিকল হওয়া নিয়ে আমরা অনেকেই ভয়ে থাকি। আমরাও যাতে রোগটিতে আক্রান্ত না হই, সেই চিন্তা থেকে যেসব কারণকে কিডনি বিকলতার জন্য সচরাচর দায়ী করা হয়, সেসব কারণ যেন আমাদের জীবনে না ঘটে, সেই বিষয়ে আমরা খুব সচেতন থাকি। কিডনি বিকল হবার কারণ নিয়ে যে কথাগুলো সমাজে বা লোকমুখে বেশ প্রচলিত, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ব্যথার ওষুধ বেশি খাওয়া।
আমরা এই নিবন্ধে জানবো, (১) কিডনি বিকল হয় কেন? (২) ব্যথার ওষুধ বেশি খেলে কি কিডনি নষ্ট হয়ে যায়? (৩) কিডনি বিকলতা থেকে বাঁচার উপায় কি?
প্রথমে আমরা কিডনি বিকলতার কারণ নিয়ে কয়েকটি নিবন্ধ দেখি। ‘যে কারণে হঠাৎ কিডনি বিকল হতে পারে’ শিরোনামে জাগো নিউজের ওয়েবসাইটে ০১ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘‘হঠাৎ করেই বিকল হতে পারে কিডনি। এর কারণ হতে পারে পানিশূন্যতা কিংবা ডায়রিয়া। যারা দৈনিক রোদে কাজ করেন ও পানি খাওয়ার সময় পান না, তাদের ক্ষেত্রে পানিশূন্যতার কারণে হঠাৎ কিডনি বিকল হতে পারে।
এ ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে ব্যথার ওষুধ খাওয়া, প্রস্টেট বড় হয়ে যাওয়া, কিডনিতে বেশি পাথর জমা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ ইউরিন ইনফেকশনের কারণে একদিনের হঠাৎ করেই কিডনি বিকল হতে পারে।
ডায়রিয়া হলেই তাৎক্ষণিক খাবার স্যালাইন খেতে হবে, যাতে পানিশূন্যতা না হয়। অনেক সময় তীব্র ব্যথানাশক ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে। তাই অবশ্যই মনে রাখতে হবে যখন তখন ব্যথানাশক ওষুধ কিংবা অ্যান্টিবায়েটিক খাওয়া যাবে না। তার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।’’
এখানে কিডনি বিকল হবার কারণ হিসেবে বেশ কয়েকটি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়। যথা: পানিশূন্যতা, ডায়রিয়া, দীর্ঘদিন ধরে ব্যথার ওষুধ খাওয়া, প্রস্টেট বড় হয়ে যাওয়া, কিডনিতে বেশি পাথর জমা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ইউরিন ইনফেকশন (মোট ৮টি)।
‘কিডনি বিকল হওয়ার কারণ কী?’ শিরোনামে দৈনিক ইনকিলাবে ০৪ অক্টোবর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ‘‘কিডনি বিকল হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। হঠাৎ কিডনি কাজ করা বন্ধ করে দিলে তাকে অ্যাকিউট কিডনি ফেইলিউর বলে।
কিডনি বিকল হওয়ার সম্ভাব্য কিছু কারণ হলো—
অটোইমিউন কিডনি রোগ
নির্দিষ্ট ধরণের ওষুধ
পানিশূন্যতা
প্রস্রাবের পথে বাধা
হৃদরোগ
লিভারের রোগ।
মনে রাখবেন, কিডনি রাতারাতি বিকল হয় না। এর জন্য সময় লাগে। একজন ব্যক্তির উভয় কিডনি বিকল হতে কয়েক মাস থেকে এক বছর সময় লাগে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে তা শরীরে রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ক্রমাগত অতিরিক্ত চিনির কারণে কিডনিসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গ—প্রত্যঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
কিডনি সমস্যার জন্য অনেকাংশে উচ্চ রক্তচাপও দায়ী। অতিরিক্ত উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনির ক্ষতি হতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিডনি বিকলও হতে পারে এ কারণে। এছাড়া দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে—পলিসিস্টিক কিডনি রোগ, যা একটি বংশগত অবস্থা। এই সমস্যা হলে কিডনির ভেতরে একটি সিস্ট তৈরি হয়।’’
এই নিবন্ধেও কিডনি বিকল হবার অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। যথা: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অটোইমিউন কিডনি রোগ, নির্দিষ্ট ধরণের ওষুধ, পানিশূন্যতা, প্রস্রাবের পথে বাধা, হৃদরোগ, লিভারের রোগ, পলিসিস্টিক কিডনি রোগ (মোট ৯টি)।
তবে এখানে বিশেষ ভাবে বলা হয়েছে, ‘‘কিডনি বিকল হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ।’’ শেষে আবারও বলা হয়েছে, ‘‘কিডনি সমস্যার জন্য অনেকাংশে উচ্চ রক্তচাপও দায়ী। অতিরিক্ত উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনির ক্ষতি হতে পারে।’’
‘হঠাৎ কিডনি বিকলের কারণ ও প্রতিকার’ শিরোনামে ঢাকা ট্রিবিউনের ওয়েবসাইটে ৩১ আগস্ট ২০২২ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘‘ভারতের হায়দ্রাবাদের যশোদা হাসপাতালের কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শশী কিরণ বলেন, একিউট কিডনি রোগটি হঠাৎ করে কিছু বোঝার আগেই হয়ে যায়। আকস্মিক কিডনি রোগের প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত ডায়রিয়া, বমি বা মাত্রাতিরিক্ত ঘামের মাধ্যমে শরীরে পানিশূন্যতা। এছাড়া যে কোনো কারণে শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে, বিভিন্ন ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে। পাশাপাশি নেফ্রাইটিস বা জীবাণুজনিত ইনফেকশন, সেপটিক শক, ডেঙ্গু জ্বর, ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়া এবং গর্ভকালীন জটিলতায়ও আকস্মিক কিডনি রোগের কারণ।
ক্রনিকের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ কিডনি রোগ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসজনিত অথবা উচ্চ রক্তচাপের কারণে হয়। এ ছাড়া ক্রনিক নেফ্রাইটিক সিনড্রমের কারণেও এ ধরনের কিডনি রোগ হতে পারে। সময় মতো কিংবা যথাযথ চিকিৎসা না করালে আকস্মিক কিডনি রোগও ক্রনিক রোগে পরিণত হতে পারে।’’
এই নিবন্ধেও কিডনি বিকলতার জন্য বেশ কয়েকটি কারণকে দায়ী করা হয়েছে। যথা: অতিরিক্ত ডায়রিয়া, বমি, মাত্রাতিরিক্ত ঘামের মাধ্যমে শরীরে পানিশূন্যতা, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, বিভিন্ন ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, নেফ্রাইটিস বা জীবাণুজনিত ইনফেকশন, সেপটিক শক, ডেঙ্গু জ্বর, ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়া, গর্ভকালীন জটিলতায়, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ (মোট ১২টি)।
এই নিবন্ধগুলোতে কিডনি বিকল হবার বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সব নিবন্ধে একই কারণকে কিডনি বিকলতার জন্য দায়ী করা হয় হয়নি। একেকটা নিবন্ধে একেকটা কারণকে দায়ী করা হয়েছে। কিডনি বিকল হবার কারণ কি সবগুলো নিবন্ধে উল্লেখিত সবগুলোই? এতো এতো কারণেই কি কিডনি বিকল হয়? এতোগুলো কারণে কিডনি বিকল হলে মানুষের পক্ষে কিডনি বিকলতা প্রতিরোধ করা কি সম্ভব হবে?
তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, নিবন্ধগুলোতে উল্লেখিত কারণগুলোর মধ্যে অল্প কিছু মিল রয়েছে। যেই কারণগুলো সব নিবন্ধে মিলে যায়, বা কমন কারণের মধ্যে রয়েছে পানিশূন্যতা, ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবের পথে বাধা, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা।
এবার আমরা এই বিষয়ে আরও একটি নিবন্ধ দেখি।
‘কিডনি বিকলের আগেই সাবধান হোন’ শিরোনামে দৈনিক কালের কন্ঠে ১৮ মে ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লেখক ডা. মো. শরিফুল হক উল্লেখ করেন, ‘‘কিডনি বিকলের কারণ হিসেবে বিশ্বে ডায়াবেটিস শীর্ষে। স্থায়ী কিডনি বিকলের কারণে ডায়ালিসিস করছে এমন প্রতি তিনজনের একজন রোগী ডায়াবেটিক। যদিও অনেক ক্ষেত্রে কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হলে ডায়াবেটিসের ওষুধ প্রয়োজন পড়ে না, বা অল্পমাত্রায় লাগে। শুরুতেই কিডনি আক্রান্ত কিনা জানতে পারলে কিডনি বিকল হওয়া প্রতিরোধযোগ্য।’’
এই নিবন্ধে কিডনি বিকলতার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘‘কিডনি বিকলের কারণ হিসেবে বিশ্বে ডায়াবেটিস শীর্ষে। স্থায়ী কিডনি বিকলের কারণে ডায়ালিসিস করছে এমন প্রতি তিনজনের একজন রোগী ডায়াবেটিক।’’
আমরা দেখেছি, প্রথমে উল্লেখিত ৩টি নিবন্ধের সবগুলোতে কিডনি বিকলতার কারণ হিসেবে ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় নিবন্ধে বিশেষভাবে বলা হয়েছে, ‘‘কিডনি বিকল হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ।’’ তৃতীয় নিবন্ধে বিশেষভাবে বলা হয়েছে, ‘‘ক্রনিকের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ কিডনি রোগ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসজনিত অথবা উচ্চ রক্তচাপের কারণে হয়।’’
আপনি আপনার পরিচিত যারা কিডনি বিকলতায় আক্রান্ত হয়েছে বা মারা গেছে, তাদের খোঁজ নিন, দেখবেন, তাদের ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ছিল। বিগত কয়েক বছরে আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন মানুষ কিডনি বিকল হয়ে মারা যায়, যাদের সবাই উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস বা উভয় রোগে আক্রান্ত ছিল।
আপনি যেকোনো কিডনি ডায়ালিসিস সেন্টারে গিয়ে দেখুন, কিডনি রোগের কারণে যারা ডায়ালিসিস করছেন, তাদের ১০ জনের মধ্যে কয়জন ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ এই রোগ দুইটির একটি বা উভয়টিতে আক্রান্ত নয়। আপনি দেখবেন, যারা ডায়ালিসিস করছেন, তাদের মধ্যে ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ এই দুইটি রোগের কোনো না কোনোটিতে আক্রান্ত নয়, এমন মানুষ একেবারে কম। চতুর্থ নিবন্ধে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘‘কিডনি বিকলের কারণ হিসেবে বিশ্বে ডায়াবেটিস শীর্ষে। স্থায়ী কিডনি বিকলের কারণে ডায়ালিসিস করছে এমন প্রতি তিনজনের একজন রোগী ডায়াবেটিক।’’ দ্বিতীয় নিবন্ধেও প্রায় একই সূরে বলা হয়েছে, ‘‘কিডনি বিকল হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ।’’
ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত নয়, এমন মানুষের কিডনি রোগে আক্রান্ত হবার ঘটনা একেবারে কম ঘটে।
‘কিডনি রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধে করণীয়’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় মেডি ভয়েস ওয়েবসাইটে ২২ মার্চ ২০২২ তারিখে। লিখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আছিয়া খানম। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘‘কিডনি রোগের ৮০ ভাগের কারণ জানা যায়না। যতটুকু জানা গেছে, সারা দুনিয়াতে কিডনি রোগের এক নাম্বার কারণ ডায়াবেটিস। বাংলাদেশে এটি দুই নাম্বার কারণ। উচ্চ রক্তচাপ সারা দুনিয়ায় ২ নাম্বার কারণ, বাংলাদেশে তিন নাম্বার কারণ। আমাদের দেশে কিডনি রোগের এক নাম্বার কারণ নেফ্রাটাইসিস। এরপর পাথর হয়ে প্রস্রাবের নালী বন্ধ হয়ে যায়।’’
এখন দুইটি প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা দরকার। (১) ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষ কেন বেশি বেশি কিডনি বিকলতায় আক্রান্ত হয়? (২) ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত নয়, এমন মানুষও কেন কিডনি বিকলতায় আক্রান্ত হয়?
এই প্রশ্ন দুইটির উত্তর খোঁজার জন্য আমাদেরকে দেখতে হবে, কিডনি বিকলতার কারণ সম্পর্কে প্রথম ৩টি নিবন্ধে ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ ছাড়া আর কি কি মিল রয়েছে? তিনটিতেই আরো দু’টি কারণের মিল রয়েছে। সেগুলো হলো: পানিশূন্যতা, ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবের পথে বাধা।
পানি কম খাওয়া বা পানিশূন্যতার কারণে কিডনি বিকল হতে পারে। আমরা জানি, শরীরের সব ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থগুলো কিডনির মাধ্যমে পরিস্রুত হয়। নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি পান না করলে ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থগুলো কিডনির মাধ্যমে পরিম্রুত হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। দীর্ঘদিন পর্যাপ্ত পানি পান না করলে তাই কিডনি সমস্যা দেখা দেয়। অনেক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ ঘন ঘন প্রস্রাব হয় দেখে পানি কম পান করেন। হয়তোবা এজন্য কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়।
পানি কম খাওয়ার কারণে ইউরিন ইনফেকশনও হয়ে থাকতে পারে বা প্রস্রাবের পথে বাধা সৃষ্টি হতে পারে বা কিডনিতে পাথর জমে যেতে পারে, যা কিডনি রোগের আরেকটি প্রধান কারণ, যেই কারণের কথা সব নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া আমরা জানি, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এজন্যেই হয়তো তারা এক সময় কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়।
কিডনি বিকল হবার আরেকটি কারণ
কিডনি বিকলতার কারণ নিয়ে প্রথমে উল্লেখিত নিবন্ধ তিনটির প্রথমটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দীর্ঘদিন ধরে ব্যথার ওষুধ খাওয়া’; দ্বিতীয়টিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নির্দিষ্ট ধরণের ওষুধ’; তৃতীয়টিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বিভিন্ন ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার’।
এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে প্রথমটি এবং শেষটি একই। কিন্তু দ্বিতীয়টিতে ব্যথানাশক ওষুধ বা এন্টিবায়োটিকের কথা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে, ‘নির্দিষ্ট ধরণের ওষুধ’। এটা ব্যথানাশকও হতে পারে, ব্যথানাশক নাও হতে পারে।
ব্যথানাশক ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে খেলে বা মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করলে কিডনি বিকল হয়ে যায়, এই বিশ্বাসটি এখন বেশ জনপ্রিয়। অসংখ্য মানুষ এই বিশ্বাসের কারণে ব্যথানাশক ওষুধ খেতে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করছে। অনেকে ব্যথা সহ্য করছে, ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু ব্যথানাশক ওষুধ খেতে চাইছে না। কিছু মানুষকে দেখেছি, কোমর বা শরীরের অন্য অঙ্গে ব্যথা নিয়ে কষ্টকর জীবন যাপন করছেন, তবু ব্যথানাশক ওষুধ খাচ্ছেন না কিডনি নষ্ট হয়ে যাবার আশঙ্কায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যথার ওষুধ খেলে সত্যিই কি কিডনি বিকল বা নষ্ট হয়ে যায়?
বাজারে ব্যথার ওষুধের কোনো অভাব নেই। অসংখ্য গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানীর ব্যথার ওষুধে বাজার সয়লাব, ওষুধের দোকান ভরপুর। শুধু বাজারে আছে, এটাই শেষ কথা নয়, ওষুধগুলো দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। অনেক ওষুধ বিভিন্ন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে বিক্রি হচ্ছে, ওষুধ বিক্রেতার পরামর্শে অনেকগুলো বিক্রি হচ্ছে, অনেকগুলো আবার রোগী নিজের সমস্যায় নিজের প্রেসক্রিপশনে কিনে খাচ্ছে। যেভাবেই হোক, ব্যথার ওষুধগুলো বিক্রি হচ্ছে খুব বেশি। কারা কিনে খাচ্ছে এই সব ওষুধ? গরু—ছাগল? না, বরং আমার আপনার মতো মানুষরাই ওষুধগুলো কিনছে, খাচ্ছে। যদি সমাজের ১০০ জন মানুষের মধ্যে ৩০ জন ব্যথার ওষুধ কিনে থাকে, খেয়ে থাকে, ওই ৩০ জনের মধ্যে কয়জন কিডনি রোগে ভোগে?
যারা কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়, তাদের যদি ৯০ শতাংশের মতো মানুষ উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস জনিত জটিলতার কারণে কিডনি রোগে ভুগে থাকেন, তাহলে স্পষ্ট বুঝা যায়, কিডনি রোগে আক্রান্ত হবার জন্য ব্যথার ওষুধ খাওয়ার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সাথে।
অনেক মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা বাত ব্যথা বা অন্য কোনো ব্যথার কারণে অনেক বছর ধরে ব্যথার ওষুধ খেয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কিডনি রোগে আক্রান্ত হননি। আমার বাবাকে দেখেছি আমার ছোটবেলা থেকেই সব সময় বাত ব্যথার ওষুধ খেতেন। কিন্তু এতোবছর তিনি কিডনি সমস্যায় ভোগেননি। কিছুদিন আগে (জুলাই ২০২৪) তার প্রস্রাব ইনফেকশনের কারণে কিডনির পয়েন্ট বেড়ে যায়। তিনি কিন্তু কয়েক বছর আগে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি এখন ভালোর দিকে আছেন। ও হ্যাঁ, তিনি কিন্তুকিডনি সমস্যা দেখা দেয়ার আগে পানি কম পান করতেন।
তাঁর কিডনির পয়েন্ট বেড়ে যাবার জন্য আপনি কোন বিষয়কে দায়ী করবেন?
তাঁর কিডনি রোগের জন্য দায়ী করার সুযোগ আছে যেই বিষয়গুলোকে, সেগুলো হলো: (১) ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবের পথে বাধা (২) পানি কম পান করা (৩) অনেক বছর ধরে বাত ব্যথার ওষুধ খাওয়া (৪) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়া।
যদি তিনি শুধু বাত ব্যথার ওষুধ খেতেন, বাকি তিনটি তাঁর মধ্যে পাওয়া না যেতো, তাহলে বাত ব্যথার ওষুধ খাওয়াকেই সুনির্দিষ্টভাবে তাঁর কিডনির পয়েন্ট বেড়ে যাবার জন্য দায়ী করা যেতো।
কিন্তু যেহেতু তিনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, আর কিডনি রোগের জন্য উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস সবচেয়ে বড় দায়ী, সেজন্য তাঁর কিডনি রোগের জন্য আপনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়াকে বাদ দিয়ে বাত ব্যথার ওষুধ খাওয়াকে দায়ী করতে পারেন না। এছাড়া যেহেতু তিনি কিডনি সমস্যা দেখা দেয়ার আগে পানি কম পান করতেন এবং তাঁর ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবের পথে বাধা সমস্যা ছিল, তাই এই দুই কারণের কোনো একটি কারণেও তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
সমাজে মানুষ যেই হারে বাত ব্যথার ওষুধ খাচ্ছে, সেই হারের কাছাকাছি হারেও যদি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হতো, তাহলে কিডনি রোগের জন্য ব্যথার ওষুধ খাওয়াকে দায়ী করার সুযোগ থাকতো। অসংখ্য মানুষ অনেক বছর ধরে ব্যথার ওষুখ খেয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত না হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, কিডনি সমস্যার সাথে ব্যথার ওষুধ খাওয়ার সম্পর্ক একেবারে দুর্বল। যেহেতু দ্বিতীয় নিবন্ধে ব্যথার ওষুধ খাওয়ার কথা না বলে বলা হয়েছে, ‘নির্দিষ্ট ধরণের ওষুধ’, তাই শুধু ব্যথার ওষুধ নয়, অন্য যে কোনো ওষুধ খাওয়ার কারণেও কিডনি রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
ব্যথার ওষুধ অনেক মানুষ মুড়ির মতো খাওয়া সত্ত্বেও সমাজে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস মুক্ত মানুষের কিডনি রোগে আক্রান্ত হবার ঘটনা একেবারে কম থাকাটাই প্রমাণ করে, ব্যথার ওষুধ খাওয়ার সাথে কিডনি রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা একেবারে কম।
‘কিডনি রোগ প্রতিরোধের ৭ উপায়’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ২২ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লেখক অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিম উদ্দিন উল্লেখ করেন, ‘‘যখন—তখন ইচ্ছে হলেই দোকান থেকে কিনে ওষুধ খাবেন না। অনেক ওষুধ আছে যা কিডনির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অনেক ওষুধ মাত্রাতিরিক্ত হলে কিডনির সমস্যা হতে পারে। বনাজি, হারবাল ওষুধ, অতিরিক্ত ভিটামিন ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্টও ক্ষতিকর হতে পারে। শিশুদের যেকোনো ওষুধে খুবই সাবধানতা জরুরি। মাত্রার একটু এদিক—ওদিক হতে পারে কিডনি রোগ প্রতিরোধের উপায়বিরাট বিপত্তি। তাই সাবধান, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ কখনো নয়।’’
এখানে তিনি ব্যথার ওষুধ বা নির্দিষ্ট কোনো ওষুধের নাম উল্লেখ করেননি। যে কোনো ওষুধ মাত্রাতিরিক্ত হলে বা লম্বা সময় ধরে ব্যবহার করলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতেই পারে। শুধু ব্যথার ওষুধ খেলেই যে কিডনি রোগ দেখা দেয়, তা নিশ্চিত নয়।
ব্যথার ওষুধ অপ্রয়োজনে খেতে যাবেন কেন?
ব্যথার ওষুধ কেউ কি সাধে খায়? ব্যথার ওষুধ কি ফ্রিতে পাওয়া যায়? মানুষ কি ব্যথা হলেও ওষুধ খাবে না? বাত ব্যথা এমন ব্যথা, যা পুরোপুরি নিরাময় হয় না কোনো ওষুধেই। কয়দিন ওষুধ খেলে ব্যথা দূর হয়ে যায়, কয়দিন পর আবার দেখা দেয়, বিশেষ করে ঠান্ডা লাগলে বা ঠান্ডা পরিবেশে থাকলে। মানুষকে তখন আবার বাত ব্যথার ওষুধ খেতে হয়। বাত ব্যথা ছাড়া অন্য ব্যথায়ও মানুষকে ব্যথামুক্ত হবার জন্য ব্যাথানাশক ওষুধ খেতে হয়। শরীরে কোনো ব্যথা না থাকলে কি মানুষ ব্যথার ওষুধ খায়?
আমি নিজেও বাত ব্যথার রোগী। ১৫ বছর বয়স থেকে আমি বাত ব্যথায় ভুগছি। ডাক্তারের পরামর্শে ব্যথার ওষুধ খেয়ে থাকি। ব্যথার ওষুধ না খেলে তো আমি পুরোই অচল হয়ে পড়বো। যখন বাত বেড়ে যায়, তখন ওষুধ খাই। ব্যথা কমে গেলে ওষুধ খাওয়া বন্ধ। এখন বাত ব্যথা বেড়ে গলে যদি আমি কিডনি নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে ওষুধ না খাই, আমার কী অবস্থা হবে? ব্যথা বেড়ে গিয়ে একসময় শয্যাশায়ী হতে হবে আমাকে।
এজন্য ব্যথা হলে ওষুধ খেতে হবে ব্যথা দূর হওয়া পর্যন্ত। ব্যথা দূর হয়ে গেলে ব্যথার ওষুধ মানুষ কেন খাবে? ব্যথার ওষুধ তো সুস্বাদু নয়!
ব্যথার ওষুধ খেলে যেই ক্ষতি নিশ্চিত
ব্যথার ওষুধ খেলে কিডনি রোগ হোক বা না হোক, একটা রোগ হয় একেবারে নগদে। রোগটির নাম হলো গ্যাস্ট্রিক। গ্যাস্ট্রিকের সাথে আরো কিছু রোগ সম্পর্কিত। মানে গ্যাস্ট্রিক থেকেই শরীরে রোগগুলো দেখা দেয়। রোগগুলো হচ্ছে— কোষ্ঠকাঠিণ্য, ক্ষুধামন্দা, অরুচি, আলসার ইত্যাদি। আমার গ্যাস্ট্রিক দেখা দেয় অনেক বছর আগে। সেই থেকে আমি গ্যাস্ট্রিক থেকে সৃষ্ট বেশ কয়েকটি সমস্যায়ও ভুগছি। বিশেষ করে কোষ্ঠকাঠিণ্য, ক্ষুধামন্দা এবং অরুচিতে ভুগছি। গ্যাস্ট্রিক দেখা দেয়ার পর অনেক বছর আমি বুঝতে পারিনি, কেন আমার গ্যাস্ট্রিক হয়েছে? সবাই যেগুলোকে গ্যাস্ট্রিকের কারণ বলে মনে করতো, সেগুলোকেই আমার গ্যাস্ট্রিকের কারণ বলে বিশ্বাস করতাম, যদিও সেগুলো আমার মধ্যে ছিল কিনা, সেদিকে লক্ষ্য করতাম না!
অল্প কিছুদিন আগে আমি নিশ্চিত হলাম, মূলত বাত ব্যথার ওষুধ খাওয়া শুরু করার পর থেকেই আমি গ্যাস্ট্রিকে আক্রান্ত হয়েছি।
গ্যাস্ট্রিক বা এসিডিটির কারণ নিয়ে একটি নিবন্ধে কী লেখা হয়েছে, দেখুন। ‘অ্যাসিডিটি কেন হয়, প্রতিকার কী’ শিরোনামে দৈনিক ইত্তেফাকে ২৫ মে ২০২২ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ‘‘পাকস্থলীর গ্যাসট্রিক গ্ল্যান্ডে অতিরিক্ত অ্যাসিড নিঃসরণের ফলে অ্যাসিডিটি বা গ্যাসের সমস্যা হয়। সাধারণত অনেকক্ষণ খালি পেটে থাকলে, অতিরিক্ত চা, কফি খেলে বা অতিরিক্ত মদ্যপান, ধূমপান, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা ইত্যাদি কারণে পেটে গ্যাস হতে পারে। অ্যাসিডিটির কারণেই পেট ফুলে ওঠে, ঢেঁকুর ওঠে, বুকজ্বলা করে এবং পেটের অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়।’’
এখানে গ্যাসের সমস্যার জন্য অনেকগুলো বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে (মোট ৬টি)।
এবার আমরা আরেকজন ডাক্তারের এই বিষয়ে বক্তব্য দেখি। ‘গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয় কেন’ শিরোনামে একটি ফিচার প্রকাশিত হয় এনটিভি’র ওয়েবসাইটে ১৩ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে। এনটিভি’র নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৬১৭তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. আফসানা বেগম। ওই অনুষ্ঠানে ডাক্তারের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে ফিচারে। ডা. আফসানা বেগম গ্যাস্ট্রিকের কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘‘দেখা যায়, আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোক সকালবেলা খায় না। এটা একটা বড় কারণ। ১২টা বা ১টার দিকে নাশতা করে। অথবা একেবারেই দুপুরের খাবার খেয়ে ফেলে। সেই ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এত লম্বা সময়, রাতে খাবার থেকে দুপুরের খাবারের মাঝখানে, ফাঁকাটা থাকে, সেটি অনেক বেশি হওয়ার কারণেই দেখা যায় যে গ্যাসট্রিকের সমস্যা বেশি হয়। এ ছাড়া আরো একটি বড় কারণ আছে। সেটি হলো বেশি রাতে খাবার খাওয়া। আমাদের অফিসের সময়, আমাদের জীবন—যাপন, এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাসায় আসতে আসতে প্রায় সময় ৮টা—৯টা বেজে যায়। প্রায়ই আমরা খাবার খাই অনেক দেরিতে। দেরিতে খাবার খাওয়ার পরপরই আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। এটিও গ্যাসট্রিকের একটি প্রধান কারণ।’’
এখানে গ্যাস্ট্রিকের জন্য প্রধান দায়ী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে দেরি করে খাবার খাওয়াকে। এর আগের নিবন্ধে গ্যাস্ট্রিকের যেই ৬টি কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর প্রথমটি হচ্ছে অনেকক্ষণ খালি পেটে থাকা।
দু’টি প্রশ্ন: (১) অনেকক্ষণ খালি পেটে থাকলে বা দেরিতে খাবার খেলে কি সত্যিই গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটি সমস্যা দেখা দেয়? (২) উপরে উল্লেখিত এই ৬/৭টি কারণ ছাড়া গ্যাস্ট্রিকের কি আর কোনো কারণ নেই? গ্যাস্ট্রিক কি শুধু এই সব কারণেই হয়?
আরো একটি নিবন্ধ দেখা যাক।
‘তেল—মসলা কি আসলেই গ্যাস্ট্রিকের জন্য দায়ী, যা বলছেন চিকিৎসক’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের ওয়েবসাইটে ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে। সেখানে এই বিষয়ে রাজধানীর ধানমন্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মেডিসিন কনসালট্যান্ট ডা. সাইফ হোসেন খানের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। ডা. সাইফ হোসেন খান বলেন, ‘‘কেউ যদি অতিরিক্ত পরিমাণ তৈলাক্ত বা মসলাদার খাবার খান, তাহলে পরিপাকতন্ত্রের কাজ খানিকটা কঠিন হয়ে পড়ে। আর আমাদের অধিকাংশ খাবার তেল ও মসলাযুক্ত হয়ে থাকে। এসব খাবার স্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হলে কিন্তু পেটের সমস্যা হয় না। অনেকে মনে করেন, গ্যাস্ট্রিকের জন্য অতিরিক্ত মসলাদার খাবার দায়ী— আসলে বিষয়টি তা নয়।
ডা. সাইফ হোসেন খান জানিয়েছেন, পরিমিত মসলা ব্যবহার করে যদি খাবার রান্না করা হয় এবং তা খাওয়া হয়, তাহলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয় না। আবার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার জন্য কিছু ভেষজ মসলা উপকারী। তবে খাদ্যে অতিরিক্ত তেল ব্যবহার আমাদের গ্যাস্ট্রিকের জন্য অবশ্যই দায়ী।’’
আমি নিজে এখন বিশ্বাস করি, গ্যাস্ট্রিকের জন্য খাদ্যে অতিরিক্ত তেল ব্যবহার এবং ব্যথার ওষুধ খাওয়া নিশ্চিতভাবে দায়ী। অন্য যেসব কিছুকে গ্যাস্ট্রিকের জন্য দায়ী করা হয়, সেগুলোর সাথে গ্যাস্ট্রিকের সম্পর্ক তেমন নেই।
দেখবেন, আগেকার মানুষ সময়মতো খাবার খেতো না অনেক সময়। কাজে কাজে সময় কেটে যেতো। তখন মানুষ এখনকার মতো খাদ্যে অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করতো না এবং ব্যথার ওষুধও তেমন খেতো না। ওই সময় ব্যথার ওষুধ এখনকার মতো সহজলভ্যও ছিল না। মানুষ তখন গ্যাস্ট্রিকে এখনকার মতো এতো ব্যাপকহারে আক্রান্ত হতো না। গ্যাস্ট্রিকের জন্য এই দু’টি কারণ ছাড়া অন্য যেগুলোর কথা বলা হয়, সেগুলোর প্রায় সবগুলো আগে মানুষের মধ্যে পাওয়া যাওয়া সত্ত্বেও মানুষ তখন গ্যাস্ট্রিকে আক্রান্ত হতো একেবারে কম।
কিন্তু এখন মানুষ ব্যথার ওষুধ বেশি বেশি খায় এবং খাবারের সাথে প্রচুর তেল ব্যবহার করে, যার ফলে এখন মানুষ ব্যাপকহারে গ্যাস্ট্রিকে ভুগছে।
কিছুদিন আগ থেকে আমি কোষ্ঠকাঠিণ্যের একটি ওষুধ খেয়ে উপকৃত হচ্ছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে বাত ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় আমি ডাক্তারের নির্দেশকৃত ব্যথার ওষুধ খেতে বাধ্য হই। ব্যথার ওষুধ খাওয়ার পর দেখলাম কোষ্ঠকাঠিণ্যের ওই ওষুধে আর কাজ হচ্ছে না। আমার কোষ্ঠকাঠিণ্য সমস্যা আবার বেড়ে গিয়েছে। এই ঘটনা থেকেই আমি নিশ্চিত হলাম, ব্যথার ওষুধ খাওয়ার কারণেই আমি গ্যাস্ট্রিকে আক্রান্ত হয়েছি।
তাই ব্যথার ওষুধ দরকার ছাড়া খাওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়।
কিডনি রোগ প্রতিরোধের ৩টি উপায়
কিডনি নষ্ট বিকলতা বা কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা কি সম্ভব? আমি মনে করি অনেকাংশেই কিডনি বিকলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। এর কারণ হচ্ছে, কিডনি বিকলতার সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের নিকট পরিষ্কার। আর তা হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া।
আপনি হয়তো ভাবছেন, কেন আমি কিডনি বিকলতার কারণ পরিষ্কার হবার সাথে কিডনি প্রতিরোধের সম্পর্ক সৃষ্টি করেছি? যেহেতু কিডনি বিকলতার অধিকাংশ ঘটনা ঘটে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কারণে আর উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস এই রোগ দুইটি সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য, তাই উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা গেলে, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ রাখতে পারলে কিডনি বিকলতাও প্রতিরোধ হয়ে যাবে।
দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসকে এখনো অনেকে অপ্রতিরোধ্য রোগ বলেই মনে করেন। এই দুইটি রোগের জন্য এমন সব কারণকে দায়ী করেন, যেগুলো শুনে মনে হয়, রোগ দুইটি প্রতিরোধযোগ্য নয়। যেমন বলা হয়, এই দু’টি রোগ বংশগত কারণেও হয়ে থকে, পূর্বপুরুষদের কেউ রোগ দুইটিতে আক্রান্ত হয়ে থাকলে সন্তানরা রোগ দুইটিতে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পায় না।
কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়। এই দু’টি রোগ কখনোই বংশগত নয়। রোগ দুইটি নির্দিষ্ট কারণে মানুষকে আক্রমণ করে। কারণটি হলো কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকা, আরামে আরামে জীবন কাটানো। পূর্বপুরুষরা কায়িক শ্রম থেকে দূর থাকার কারণেই রোগ দুইটিতে আক্রান্ত হয়েছে কিনা, তা না দেখে এই দু’টি রোগে আক্রান্ত মানুষকে বলে দেয়া হয়, তাদের রোগগুলো বংশগত কারণে হয়েছে। মূলত যাদের রোগগুলোকে বংশগত মনে করা হয়, তাদের পূর্বপুরষরা কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকার কারণেই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়েছিল, আর তারাও আরামে আরামে জীবন কাটানোর কারণেই, কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকার কারণেই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়েছে। রোগগুলো মোটেই বংশগতভাবে হয় না। রোগগুলোর প্রকৃত কারণ না জানার কারণেই রোগগুলোকে বংশগত রোগ বলে ভুল করা হয়।
রোগগুলো সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য। মানুষ চেষ্টা করলেই রোগগুলো থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ রাখতে পারে। নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘাম ঝরানো কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করলেই মানুষ এই রোগগুলো থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকতে পারে।
যারা নিজেদেরকে এই রোগ দুইটি থেকে নিরাপদ রাখতে পারবেন, তারা কিডনি বিকলতা থেকেও প্রায় শতভাগ নিরাপদ থাকবেন।
কিডনি রোগ প্রতিরোধের আরও দুই উপায়
কিডনি রোগে আক্রান্ত হবার আরও দুইটি জানা কারণ হচ্ছে পানি কম পান করা বা অপর্যাপ্ত পানি পান করা এবং প্রস্রাব চেপে রাখা।
পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান না করলে কিডনির ওপর চাপ পড়ে। শরীরের যাবতীয় টক্সিন বের করার জন্য পানি জরুরি। শরীরে দিনে ৩—৪ লিটার পানি দরকার। এর কম খাওয়া কখনোই উচিত নয়। বেশি খেলে সমস্যা নেই। নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করলে কিডনি রোগ থেকে বাঁচার সম্ভাবনা বাড়বে।
অনেকেই কর্মক্ষেত্রে বা বাইরে গেলে প্রস্রাব চেপে রাখেন। অনেকে কোনো জরুরী কাজে ব্যস্ত থাকলে প্রস্রাবের বেগ থাকা সত্ত্বেও প্রস্রাব করতে দেরি করেন। এই অভ্যাস বিপদজনক। মূত্রনালিতে চাপ পড়লে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘ সময় শরীরে টক্সিন আটকে থাকে এবং শরীরে সংক্রমণ ছড়ায়। তাই প্রস্রাবের চাপ দেখা দিলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব প্রস্রাব করুন। চেপে রাখার মনোভাব দূর করুন। এতে কিডনি রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কমবে।
নূর আহমদ
ফিটনেস বিষয়ে অধ্যয়নরত।