টেনশনে মানুষ কি সত্যিই কোনো রোগে আক্রান্ত হয়?
টেনশনে মানুষ কি সত্যিই কোনো রোগে আক্রান্ত হয়?
নূর আহমদ
টেনশনে অনেক রোগ হয় বলেই আমরা মনে করি। আমাদের কাছের কেউ কোনো বিষয় নিয়ে টেনশন বা মানসিক অস্থিরতায় ভুগলে আমরা তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে যাই। ভাবি, সে মারাত্মক কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে কিনা! মানসিক অস্থিরতায় ভোগা মানুষ নিজেও দুশ্চিন্তায় থাকেন, কখন কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। মানসিক অস্থিরতাকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় ব্রেইন স্ট্রোকের জন্য। হার্ট অ্যাটাকের জন্যও মানসিক অস্থিরতাকে একচেটিয়াভাবে দায়ী করা হয়। আজ আমরা এই বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করবো।
- যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী; ফাঁসির আসামী; কোনো মামলায় অন্যায়ভাবে ফেঁসে যাওয়া নিরীহ মানুষ।
- চাকরির পেছনে ছোটা বেকার যুবক।
- শারীরিক বা মানসিক সমস্যাগ্রস্থ সন্তানের বাবা—মা বা অভিভাবক।
- নিরীহ বিধবা অথবা বয়স্ক মানুষ, যাকে দেখাশোনা করার মতো তেমন কেউ নেই।
- বিবাহ—বিচ্ছেদের শিকার নারী, যার অন্য কোথাও বিয়ে হচ্ছে না।
- বিবাহ—বিচ্ছেদের শিকার মধ্যবয়সী নারী, সন্তানের দিকে তাকিয়ে যে নারী পুণবিবাহে সম্মত নয়।
- অভাবী, ঋণগ্রস্থ বা সাংসারিক টানাপোড়েনে সর্বদা জর্জরিত মানুষ।
- মধ্যবয়সে, যখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স থাকে না, তখন কোনো কারণে চাকরিচ্যুত মানুষ।
- ব্যবসায় লোকসান হয়ে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুণ লেগে সর্বস্ব হারানো মানুষ; শেয়ারবাজারে দেউলিয়া হওয়া মানুষ; বড় ধরণের কোনো প্রতারণার শিকার হওয়া মানুষ।
- বেশি বেশি দাম্পত্য কলহে লিপ্ত দম্পতি।
- জায়গাজমি বিক্রয় করে বা ঋণ নিয়ে বিদেশ গিয়ে দুর্ভাগ্যবশত দেশে ফেরত আসা মুানষ।
- দুরারোগ্য বা অনিরাময়যোগ্য কোনো ব্যাধিতে (ক্যান্সার, পক্ষাঘাত ইত্যাদি) আক্রান্ত মানুষ।
- নিঃসন্তান, একমাত্র ছেলে বা সন্তানহারা দম্পতি, যাদের আর সন্তান গ্রহণের সুযোগ নেই।
- কন্যাদায়গ্রস্থ অভিভাবক; অনেক বয়স হয়ে যাবার পরও বিয়ে হচ্ছে না, এমন মেয়ে।
- মর্মান্তিক কোনো দুর্ঘটনায় পরিবারের একাধিক প্রিয়জনহারা মানুষ।
- কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বা জন্মগতভাবে শারীরিক সমস্যাগ্রস্থ মানুষ।
- জায়গাজমি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে সারাক্ষণ ঝগড়া—দ্বন্দে জড়িয়ে থাকা মানুষ।
এই ১৭ শ্রেণির মানুষ, যারা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে এরকম কোনো সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জীবনে টেনশনের মাত্রা কেমন, তা যারা এইরকম সমস্যায় ভুগছেন, তারা ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন না। তবে যাদের আশেপাশে এমন মানুষ আছেন, তারা কিছুটা হলেও টের পান।
এই ১৭ শ্রেণির ১০০০ জন মানুষের খোঁজ নিলে দেখা যাবে, পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে এরা এভাবে নানা টেনশনে দিন কাটালেও এই এক হাজার জনের মধ্যে চার—পাঁচ জনের বেশি মানুষ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হননি। হৃদরোগে (হার্ট অ্যাটাক) আক্রান্ত হবার সংখ্যাও খুব বেশি হবে না।
পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে টেনশনে থাকা সত্ত্বেও কেন ৯৫ শতাংশের বেশি মানুষ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হননি? কারণ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার জন্য টেনশন কোনোভাবেই দায়ী নয়। যদি দায়ী হতো তাহলে পাঁচ বছর ধরে ‘যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী, ফাঁসির আসামী, কোনো মামলায় অন্যায়ভাবে ফেঁসে যাওয়া নিরীহ মানুষ’রা ব্রেইন স্ট্রোক থেকে কোনোভাবেই নিরাপদ থাকতো না। কারণ উপরে উল্লেখিত এই ১৭ শ্রেণির মধ্যে আর কেউ টেনশন না করলেও কমপক্ষে এই শ্রেণির মানুষ অবশ্যই টেনশনে টেনশনেই প্রতিটা দিন কাটায়। টেনশনে মানুষ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে পাঁচ বছর নয়, কারাগারে যাওয়ার এক বছরের মধ্যেই এরা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পড়তো।
ঋণের দায়ে জর্জরিত বা অভাবে অভাবে দিন কাটানো অসংখ্য মানুষ আছেন আমাদের আশেপাশে, যারা বছরের পর বছর ধরে এভাবে অভাবে অভাবে দিন কাটানো সত্ত্বেও ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হচ্ছেন না। অনেক মানুষ অভাবের তাড়নায় বা ঋন পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার পথও বেছে নেন। এসব মানুষ আত্মহত্যার আগে নিশ্চিতভাবে ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতেন, যদি সত্যিই টেনশনে মানুষ এসব রোগে আক্রান্ত হতো। কিছুদিন আগে ঢাকার ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান ১৬ মিনিটের বেশি সময় ধরে ফেসবুক লাইভে ব্যক্তিজীবনের হতাশার কথা বলে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তিনি নিশ্চয়ই অনেক আগ থেকেই নানা রকম হতাশায় ভুগছিলেন। এরকম হতাশাগ্রস্থ মানুষগুলো ব্রেইন স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক থেকে নিরাপদ থেকে আত্মহত্যার সুযোগ পেতেন না, যদি সত্যিই টেনশনে মানুষ এসব রোগে আক্রান্ত হতো।
আমি একজন লোককে চিনি, যার দুই ছেলে। দুই ছেলের উভয়েই জন্মগতভাবে শারীরিক সমস্যাগ্রস্থ। সেই লোক এবং তার স্ত্রী এখনো ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হননি। আপনিও দেখবেন আপনার পরিচিত যাদের কোনো সন্তান অনেক আগ থেকে শারীরিক বা মানসিক সমস্যাগ্রস্থ, তারা ব্রেইন স্ট্রোক আক্রান্ত হচ্ছেন না। অথচ এদেরকে নিয়ে এদের বাবা—মায়ের টেনশনের অন্ত নেই। আমার পরিচিত চার—পাঁচ জন লোক আছে মানসিক সমস্যাগ্রস্থ। অথচ তাদের বাবা—মা কেউ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হননি এখনো! এটা সম্ভব হতো না যদি টেনশনে মানুষ সত্যিই ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হতো!
এই বিষয়গুলোর দিকে তাকালেই স্পষ্ট হবে, টেনশনের সাথে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার কোনো সম্পর্ক নেই।
আপনার পরিচিত যেই লোকগুলো আছেন এই ১৭ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, আপনি দেখবেন তারা কেউই এখনো ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়নি। অন্যদিকে বিগত ১০ বছরে আপনার পরিচিত যারা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে এই ১৭ শ্রেণির অন্তভুুর্ক্ত হয়তো কেউ নেই।
মানুষের জীবনে টেনশন থাকেই। অনেকের জীবনে টেনশনের উপলক্ষ্য বেশি, অনেকের জীবনে কম। আমি আমার জীবনের প্রথম ২১ বছরে তেমন কোনো টেনশনে ছিলাম না। কিন্তু শেষ ২১ বছরে বিভিন্ন বিষয়ে এতো বেশি টেনশনে পড়েছি, যদি টেনশনে মানুষ সত্যিই ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হতো, তাহলে আমি এই পর্যন্ত বেশ কয়েকবার ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হতাম!
আমার পরিচিত যারা বিগত কয়েক বছরে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা কেউই এই ১৭ শ্রেণির অন্তভুর্ক্ত নন। তাদের জীবনে হয়তো টেনশন ছিল। কিন্তু এমন গুরুতর কোনো টেনশনে কেউই ছিলেন না।
টেনশন একটা নন্দঘোষ
টেনশন একটা নন্দঘোষ। কেউ টেনশন না করা সত্ত্বেও যদি ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়, তবু সবাই ধরে নেয় সে নিশ্চয়ই টেনশনে ছিল! বিগত কয়েক বছরে আমার পরিচিত অনেক মহিলা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। মহিলাদের জীবনে পুরুষদের তুলনায় টেনশন কম। তবু কেন মহিলারা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন?
ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার জন্য কি ধূমপান দায়ী?
ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার জন্য ধূমপানকেও দায়ী করা হয়। ধূমপানের সাথে সরাসরি বা অসরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই, বাংলাদেশে এমন অসংখ্য মানুষ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। বিশেষ করে মহিলারা এবং মাদ্রাসা—শিক্ষিত মানুষরা। ধূমপানে মানুষ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে এই দুই শ্রেণির মানুষও কেন ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়? মহিলা এবং মাদ্রাসা—শিক্ষিত মানুষ ছাড়া অন্য মানুষদের মধ্যে যারা ধূমপান করেন না, তারাও ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। ধূমপানের সাথে ব্রেইন স্ট্রোকের সম্পর্ক এমনভাবে করা হয়, যেন ধূমপান করলে ব্রেইন স্ট্রোক থেকে বাঁচার কোনো সুযোগ—ই নেই। অথচ দেখা যায়, ৩০—৪০ বছর ধরে ধূমপান করেও ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া ছাড়া অসংখ্য মানুষ পৃথিবী ত্যাগ করেন। এটা কিভাবে সম্ভব হতো, যদি ধূমপানে সত্যিই মানুষ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হতো! অধূমপায়ী হাজার হাজার ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত মানুষের পাশাপাশি কিছু ধূমপায়ীকেও ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে দেখেই ধূমপানের ঘাড়ে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার দোষটা চাপিয়ে দেয়া হয়। এমনভাবে দোষ চাপানো হয়, মনে হয় ধূমপান নামক জিনিসটা পৃথিবীতে না থাকলে শুধু ধূমপায়ীরা নয়, অধূমপায়ীরাও বে্্রইন স্ট্রোক নামক রোগটিতে আক্রান্ত হতো না! ধূমপানকে ব্রেইন স্ট্রোকের জন্য দায়ী করার সুযাগ থাকতো তখন, যখন দেখা যেতো কেবল ধূমপায়ীরাই ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, অধূমপায়ী কেউ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় না।
ব্রেইন স্ট্রোকের কোনো কারণই এখনো পরিষ্কার নয়
মূলতঃ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যে যা—ই বলুক, ব্রেইন স্ট্রোকের কোনো কারণই এখনো পরিষ্কার নয়। আমরা অকারণে টেনশন এবং ধূমপানকে এই রোগটির জন্য দায়ী বলে মনে করছি। ‘যে কারণে ব্রেইন স্ট্রোক হয়’ শিরোনামে সময় নিউজের ওয়েবসাইটে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘‘অধিক পরিমাণে লবন খাওয়া, চর্বি খাওয়া এবং রক্তে অতিমাত্রায় কোলেস্টেরলের উপস্থিতি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিকস ও উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোক আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি করে। আমাদের দেশে স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৬০—৭০ ভাগ রোগী অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের জটিলতা হিসেবে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকে। যদিও স্ট্রোকের সঠিক কারণ নির্ণয় করা এখনো সম্ভব হয়নি।’’
এখানে বলা হয়েছে, ‘স্ট্রোকের সঠিক কারণ নির্ণয় করা এখনো সম্ভব হয়নি।’ আশা করি ব্রেইন স্ট্রোকের কারণ নিয়ে মন্তব্য করতে আমরা একটু ভেবেচিন্তে কথা বলবো। নয়তো মানুষ বিভ্রান্ত হবে। অকারণে টেনশনকে ভয় করবে, কোনো বিষয়ে টেনশনে পড়লে মানুষ সব সময় ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে পড়ার ভয়ে শঙ্কিত থাকবে। পাশাপাশি টেনশন বা ধূমপানকে এই—সেই রোগের কারণ বলে মন্তব্য করতেও আমরা তাড়াহুড়ো করবো না। এতে রোগগুলোর সত্যিকারের কারণ চুপিসারে আমাদের ক্ষতি করবে।
তবে এটা ঠিক, টেনশনে কিছু কিছু মানুষ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। সবাই নয়। কেন? যাদের শরীরে চর্বি বা কোলেস্টেরল বেশি, তারা টেনশন করলে তাদের রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে তাদের হার্ট ব্লক্ড হয়ে তারা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে যারা নিয়মিত কায়িক শ্রমের সাথে সম্পর্ক রাখে, তাদের শরীরে চর্বি জমতে পারে না, তাদের প্রেশার সবসময় নরমাল থাকে বলে তাদের জীবনে যতো টেনশনই থাকুক, তারা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় না।
কিছুদিন আগে আমি একটি ফার্মেসিতে উপবিষ্ট ছিলাম। আমার পরিচিত একজন লোক এসেছেন তাঁর প্রেশার মাপতে। লোকটি ছিলেন নিয়মিত কায়িক শ্রমে নিযুক্ত একজন মানুষ। ফার্মাসিস্ট তার প্রেশার মাপতে গিয়ে আগাম বলে দিলেন, তার প্রেশার হবে লো। শেষে তা—ই হলো।
আমার বিগত কয়েক বছরের জীবনে আমি নানা টেনশনে দিন কাটিয়েছি। করোনার দুই বছর তো টেনশনে টেনশনেই ছিলাম। একবার শরীরে এলার্জিজাতীয় একটি সমস্যা দেখা দেয়ায় ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার প্রেশার মেপে দেখলেন আমার প্রেশার লো। আমাকে তিনি এটা—সেটা খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। আমি তো জানি, আমি যা—ই খাই না কেন, আমার প্রেশার লো—ই থাকবে। কারণ আমি নিয়মিত কায়িক শ্রমের চেষ্টা করি। এজন্য আমার শরীরে চর্বি জমতে পারছে না।
জার্মানীর জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে ১৪.১০.২০১৭ তারিখে প্রকাশিত ‘ভারতে তরুণ প্রজন্মের পুরুষদের মধ্যে হৃদরোগ বিশ্বে সর্বাধিক’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সব হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে একমত যে, নিয়মিত শরীরচর্চা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হৃদরোগ ঠেকানোর অন্যতম উপায়।’
সেখানে আরো বলা হয়, ‘তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, অর্থাৎ তিরিশের আশপাশে যাঁদের বয়স, তাঁদের মধ্যে ইদানিং দেখা যাচ্ছে, হৃদরোগের হার ক্রমশই বাড়ছে। এর কারণ কী? হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ দেবব্রত রায় ডয়চে ভেলেকে এই প্রসঙ্গে বললেন, এর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, লাইফ স্টাইল। কারণ, ছোট থেকেই বাচ্চারা খেলাধুলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বাড়ছে ফাস্ট ফুড খাওয়া। এরজন্য মোটা হচ্ছে। ওজন বাড়ছে কিশোর বয়স থেকেই। অল্প অল্প করে রক্তে বাড়ছে শর্করা, বাড়ছে কোলেস্টেরল। এর ফলে ধমনির দেওয়ালে কিছু কিছু খারাপ চর্বি জমা হয়। এবার রক্তে¯্রাতে যদি একটা ঘূর্ণন তৈরি হয়, তখন সেটা ফেটে গেলে তৈরি হয় জমাট বাঁধা একটা রক্তের ঢেলা। সেটা থেকেই হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা। তখন ২৫—৩০ বছর বয়সেই হয় হার্ট অ্যাটাক।’
সবশেষে মানসিক চাপের সাথে হার্ট অ্যাটাকের সম্পর্ক নিয়ে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন উল্লেখ করছি। ১০ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখের বিবিসি বাংলায় ‘মানসিক চাপের সাথে হার্ট অ্যাটাকের সম্পর্ক নেই’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘একটা সময় মনে করা হতো মানসিক চাপ, অবসাদ কিংবা অসুখী হলে মানুষের মৃত্যু হয়। কারণ মানসিক চাপে থাকলে সেটি হৃদপিন্ডের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং হার্ট অ্যাটাক হয়।
কিন্তু যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ল্যানস্যাটে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হচ্ছে অতীতের এই ধারনা ভুল ছিল এবং সেটি মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।
যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার গবেষকরা গত বারো বছর ধরে যৌথভাবে এই জরিপ চালিয়েছেন।
এই জরিপে উভয় দেশের ১০ লাখ নারীর মতামত নেয়া হয়েছে। এরপর সেটির ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গবেষণায় যে বিষয়টি দেখার চেষ্টা হয়েছে তা হলো— মানুষ কতটা সুখী? সুখী হলেই কি মানুষ বেশি দিন বাঁচে?
যাদের উপর এই গবেষণা চালানো হয়েছে তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল— তাদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা কেমন? তারা কি সুখী? তাদের মানসিক চাপ কতটা আছে? ইত্যাদি প্রশ্ন।
এই গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক বলছেন, “মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলে অসুখী হয়। কিন্তু অসুখী হলে মানুষ মারা যায় না।” তিনি বলছেন মানুষের মৃত্যুর সাথে অসুখী হবার কোন সরাসরি সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
এই গবেষণা দলের আরেকজন সদস্য এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার রিচার্ড পিটো বলেন, ১০ বছর ধরে গবেষণা চালানোর সময়টিতে তারা লক্ষ্য করেছেন যারা কম ধূমপান করেন তাদের কম বয়সে মারা যাবার সম্ভাবনা দ্বিগুণ।
আর যারা বেশি ধূমপান করেন তাদের কম বয়সে মারা যাবার সম্ভাবনা তিনগুণ। কিন্তু দশ বছর ধরে যারা মানসিক চাপে ভুগছেন কিংবা অসুখী রয়েছেন তারা মারা যাননি।
গবেষক মি: পিটো বলেন, “কিন্তু অনেকেই মনে করে মানসিক চাপে থাকলে কিংবা অসুখী হলে হার্ট এ্যাটাক হয়। এটা সত্য নয়। আসলে অনেক মানুষ এটা ভাবতে পছন্দ করে।”
তবে গবেষকরা বলছেন কেউ যদি শৈশবে অসুখী থাকে তাহলে সেটি তার উপর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’
এই গবেষণা প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়, ‘অনেকেই মনে করে মানসিক চাপে থাকলে কিংবা অসুখী হলে হার্ট এ্যাটাক হয়। এটা সত্য নয়। আসলে অনেক মানুষ এটা ভাবতে পছন্দ করে।’
হার্ট অ্যাটাকের জন্য মানসিক চাপ সরাসরি দায়ী নয়
হার্ট অ্যাটাকের জন্য মানসিক চাপ যে সরাসরি দায়ী নয়, অন্তত এ কথাটা বিশ্বাস করতে এ গবেষণা প্রতিবেদন সবাইকে সহায়তা করবে। আমরা নিজেরাও আমাদের আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবো, সুখী মানুষরাই, বিশেষ করে যেসব সুখী মানুষ সুখে থাকার পাশাপাশি আরামে থাকতেও পছন্দ করে, তারাই বেশি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। আর যাদের জীবনে মানসিক অস্থিরতা বেশি, তাদের মধ্যে যারা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে, শুধু তারাই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে মানসিক অস্থিরতায় দিন কাটানো সত্ত্বেও যারা নিয়মিত কায়িক শ্রম করে, তারা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় না। বিষয়টা হাজার বার যাচাই করা হলেও একই ফল মিলবে। আশা করি হার্ট অ্যাটাকের কারণ সম্পর্কে অনর্থক কোনো কিছুকে দোষারোপ করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা থেকে সবাই সতর্ক হবো।
নূর আহমদ
শিক্ষক; কলামিস্ট ও ফিটনেস বিষয়ে অধ্যয়নরত।