ডায়াবেটিস কেন হয়? মিষ্টি খেলে কি ডায়াবেটিস হয়? বেশি চিনি খাওয়া কি ক্ষতিকর?
চিনি বা মিষ্টি খাওয়ার সাথে ডায়াবেটিস ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হবার সম্পর্ক
ডায়াবেটিসের ভয় সমাজে যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তত মিষ্টিজাতীয় খাবার বা চিনি খাওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। কাশেম নামে আমার এক বন্ধু আছে, তার সাথে চা খেতে গেলে দেখি, সে সবসময় চিনি কম দিয়ে চা দেয়ার জন্য বলে। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন আপনি চিনি কম খাচ্ছেন?’ তিনি বললেন, ‘চিনি বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এজন্য।’ আমার সহকর্মী এবং পরিচিত অনেক মানুষকে দেখি, চিনি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন। হোটেলে বা চায়ের দোকানে দেখা যায়, অনেক মানুষ চিনি—ছাড়া চা দিতে বলেন। যারা চিনি—ছাড়া চা দিতে বলেন, তারা সবাই যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তা নয়, অনেকে ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকার জন্যও চিনি—ছাড়া চা খান।
‘চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয়’, এই ধারণাটা বিশ্বব্যাপী দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেতনতার অংশ হিসেবে মানুষ চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবারকে বয়কট করতে শুরু করেছে।
‘চিনি বা মিষ্টি বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয়’ এই ধারণাটা সমাজে কিভাবে ছড়িয়েছে?
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ চিনি—মিষ্টি খেলে তাদের ডায়াবেটিস বেড়ে যায়, এটা সত্য। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষরা চিনি—মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস বেড়ে যায়— এটা দেখে মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, যেহেতু চিনি—মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস রোগীর ডায়াবেটিস বেড়ে যায়, তাই এগুলো না খেলে হয়তো ডায়াবেটিস হবে না। এভাবেই হয়তো চিনি—মিষ্টি খাওয়ার সাথে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্পর্কটা তৈরি হয়েছে।
তবে সাধারণ মানুষের এই মনগড়া ধারণার পাশাপাশি ধারণাটি সমাজে ছড়ানো হচ্ছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও।
আপনি কি কখনো চিনিকে ‘নীরব ঘাতক’ বা ‘সাদা বিষ’ বলতে শুনেননি বা কোথাও পড়েননি? আমি শৈশবকাল থেকেই চিনিকে নীরব ঘাতক বলার কথা শুনে আসছি। এখনো মাঝে মাঝে চিনির বিরুদ্ধে অনেক নিবন্ধ বা প্রতিবেদন পত্রিকায় চোখে পড়ে। কিছু নিবন্ধ—প্রতিবেদন দেখা যাক।
‘কেন সাদা চিনি এড়িয়ে চলবেন?’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে ডা. তানজিনা হোসেন (সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম বিভাগ, গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজ) লিখিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘‘...গ্লুকোজ থেকে আমরা প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করি। সাদা চিনি কিন্তু তা নয়। সাদা চিনি হলো সুক্রোজ, যা ভাঙার প্রয়োজন হয় না, দ্রুত রক্তে মিশে যায় এবং রক্তে চিনির পরিমাণ দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। আমাদের মেটাবলিক সিস্টেম এই চিনিকে সামলে উঠতে পারে না এ কারণে যে, আদিকালে কোনো চিনি ছিল না, শর্করার উৎস ছিল শস্য বা ফলমূল আর এই জন্যে মেটাবলিক সিস্টেম সেভাবে গড়ে ওঠেনি আমাদের শরীরে। তো এই বাড়তি চিনি তখন একধরনের চর্বি (ট্রাইগ্লিসারাইড) হিসেবে শরীরে জমা হতে থাকে। তাই সাদা চিনি খেলে কেবল ওজন এবং শর্করা বাড়ে তা—ই নয়, চর্বিও বাড়ে। ফলে দেখা দেয় স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফ্যাটি লিভারসহ অনেক কিছু।...’’
‘চিনির ক্ষতিকর দিক’ শিরোনামে দৈনিক ইত্তেফাকে ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ডা. সঞ্চিতা বর্মন লিখেন, ‘‘বাঙালি খাদ্য তালিকায় ও রান্নায় খাবারকে আরো মুখরোচক করতে চিনির ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। চিনির পাশাপাশি মিষ্টি, মিষ্টি পানীয় ও মিষ্টি ফলেরও জুড়ি নেই। কিন্তু খাবারে এই অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার গ্রহণ হতে পারে জীবনের জন্য ক্ষতিকর।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা খাবারে অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় পানীয় বেশি খায় তাদেরই হৃদরোগ, ডায়াবেটিস টাইপ ২, উচ্চ রক্তচাপ, ওবেসিটি বা স্থূল দেহ এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ শরীরের মেটাবলিজম প্রক্রিয়াকেও বিঘ্ন ঘটায়।’’
‘‘তামাকের মতই ক্ষতিকর চিনি, দাবি ব্রিটিশ গবেষকের!’’ শিরোনামে বাংলাদেশ প্রতিদিনে ২৯ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘মিষ্টি খাবার মানেই চিনি। অথচ এই চিনিই কিনা তামাকের মতো ক্ষতিকর। এমন অবিশ্বাস্য তথ্যই দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের ইউনির্ভাসিটি অব লিভারপুলের গবেষক সায়মন ক্যাপওয়েল। চিনিকে নতুন তামাক হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন তিনি।...
চিনির ক্ষতিকারক প্রভাব মানুষের স্থূলতা, বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধির পেছনে দায়ী।...
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বিশ্বব্যাপী স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে মৃত্যুর পেছনে মূল ভূমিকা চিনির। উলফসন ইন্সটিটিউট অব প্রিভেনটিভ মেডিসিনের গবেষক গ্রাহাম ম্যাকগ্রেগর বলেন, এখনই বিশ্বব্যাপী চিনির ক্ষতিকর দিক নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’’
‘‘প্রতিবছর শুধুমাত্র অতিরিক্ত চিনি খেয়েই মৃত্যু ৩.৫ কোটি মানুষের’’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক যুগান্তরে ২৪ অক্টোবর ২০২০ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘‘ বিশ্বে সংক্রামক রোগে যত মানুষ আক্রান্ত হন, তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ অসুস্থ হন চিনির বিষক্রিয়ায়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে নানা রোগে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মারা যান। খবর দ্যা নেচার পত্রিকার।
চিনিতে আছে পুষ্টিহীন ক্যালোরি। যা খেলে ওজন বাড়ে। ডায়াবিটিস থাকলে বাড়ে তার প্রকোপ। এ ছাড়াও মাত্রাতিরিক্ত খেলে হার্ট ও লিভারে ইনফেকশন হয়, হরমোনের মাত্রা ওঠানামা করে, কোলেস্টেরল ট্রাইগ্লিসারাইড বাড়ে, বাড়ে ক্যানসারের আশঙ্কাও।
প্রকাশিত রিপোর্টে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে নানা রোগে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মারা যান। সংক্রামক রোগে যত মানুষ আক্রান্ত হন, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ অসুস্থ হন চিনির বিষক্রিয়ায়।’’
এই প্রতিবেদনগুলোয় স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপের কারণ হিসেবে অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। কিছু কিছু গবেষণাও নাকি এমনই বলছে! এমনকি বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়েও বলা হয়েছে, ‘‘বিশ্বব্যাপী স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে মৃত্যুর পেছনে মূল ভূমিকা চিনির।’’ এতোকিছুর পরও চিনিকে মানুষ ভয় না করে পারে?
এবার আমরা আরো কিছু নিবন্ধ—প্রতিবেদন দেখি।
‘‘ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেতন হোন’’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ (সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিফ কো—অর্ডিনেটর) লিখেন, ‘‘ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা ও ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়।’’
‘‘মিষ্টি কি আসলেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?’’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘বলা হয়, যারা বেশি মিষ্টি খায় তাদের টাইপ—টু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি।
চিনি, শর্করাা, সুগার — যে নামেই ডাকুন, গত কয়েক দশকে বিজ্ঞানী আর ডাক্তারদের ক্রমাগত সতর্কবার্তার ফলে এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জনস্বাস্থ্যের এক নম্বর শত্রু।
সরকার এর ওপর কর বসাচ্ছে। স্কুল আর হাসপাতালগুলো খাদ্যতালিকা থেকে একে বাদ দিয়ে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন: আমাদের খাবার থেকে চিনি সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দিতে।
আমরা সবসময়ই শুনছি, যারা বেশি মিষ্টি খায় তাদের টাইপ—টু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি।
কিন্তু এর বিপরীতেও একটা কথা আছে। আসলে এসব স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য শর্করাই যে দায়ী — তা হয়তো না—ও হতে পারে।
ঠিক কিভাবে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এই শর্করা — তা বের করতে গিয়ে কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখছেন, এটা প্রমাণ করা খুব কঠিন। বিশেষ করে যখন তা উচ্চমাত্রার ক্যালরি সমৃদ্ধ খাদ্যের সাথে খাওয়া না হচ্ছে।
গত পাঁচ বছরে একাধিক গবেষণার ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোন এক দিনের খাবারে যদি ১৫০ গ্রামের বেশি ফ্রুকটোজ থাকে, তাহলে তা উচ্চ রক্তচাপ বা কোলেস্টেরলের মতো সমস্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কিন্তু গবেষকরা আরো বলেছেন যে, এটা তখনই ঘটে, যখন আপনি উচ্চ ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবারের সাথে উচ্চমাত্রায় শর্করাসমৃদ্ধ খাবার খাচ্ছেন। তারা আরো বলছেন, শুধু সুগারের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয় এটা বলা যায় না।
তা ছাড়া, বিজ্ঞানীরা আরো বলছেন যে, কোন একটি খাবারকে সমস্যার মূল কারণ বলে চিহ্নিত করারও অনেক বিপদ আছে — কারণ এর ফলে এমন হতে পারে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় কোন খাবার হয়তো আপনি খাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, উচ্চ মাত্রার ফ্রুকটোজ সমৃদ্ধ কর্ন সিরাপ বা বাড়তি চিনিওয়ালা পানীয়, জুস ড্রিংক, মধূ বা সাদা চিনি এগুেলো হৃদযন্ত্রের সমস্যা তৈরি করতে পারে, কারণ তা ধমনীর ভেতর ট্রাইগ্লিসারাইড জাতীয় চর্বি জমাতে ভুমিকা রাখে।
বিভিন্ন জরিপে এই বাড়তি যোগ করা চিনিসমৃদ্ধ খাবার বা পানীয়ের সাথে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্পর্ক দেখা গেছে।
কিন্তু সুগারের কারণেই যে হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস হয় — এটা স্পষ্ট করে বলার উপায় এখনো নেই। লুজান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুক টাপি বলছেন, অতিরিক্ত ক্যালরিই ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং উচ্চ রক্তচাপের কারণ এবং সুগার সেই উচ্চ ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবারের একটা অংশ মাত্র।
এমন দেখা গেছে, যারা এ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদ — তারা বেশি শর্করা খেলেও শারীরিক পরিশ্রম বেশি করছেন বলে তা হজম হয়ে যাচ্ছে — কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না।’’
এই দু’টি প্রতিবেদনে চিনি বা মিষ্টির ক্ষতিকর প্রভাবের কথা অনেকটা নাকচ করে দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কোন্ ধরনের মতামত বিশ্বাস করবেন? ‘চিনি বা মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়’ এর পক্ষে আরো অনেক রেফারেন্স যেমন উল্লেখ করা যাবে, ‘এগুলো খেলে ডায়াবেটিস হয় না’, এই কথার পক্ষেও আরো অনেক রেফারেন্স উল্লেখ করা যাবে। কিন্তু আপনি বা আমি কোন্ ধরনের মতামতকে বিশ^াস করবো? তবে এই সত্যটা আমাদের নিকট স্পষ্ট, এই বিষয় নিয়ে যারা ভাবছে, গবেষণা করছে বা মতামত প্রদান করছে, তারা আমাদেরকে বিভ্রান্ত করছে। তারা একমত হয়ে সবাই মিলে আমাদেরকে একই রকম মতামত দিলে আমরা বিভ্রান্ত হতাম না।
চলুন, আমরা তাদের সৃষ্টি করা বিভ্রান্তিতে না পড়ে নিজেরাই যাচাই করে দেখি, কোন্ মতামতটি সঠিক এবং বাস্তবসম্মত? চিনি বা মিষ্টি খাওয়া কি ক্ষতিকর, নাকি ক্ষতিকর নয়? চিনি বা মিষ্টি বেশি খেলে কি মানুষ ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, নাকি হয় না?
যাচাই করার জন্য আমরা দ্বিতীয় প্রকারের দু’টি রেফারেন্সের শেষটি থেকে একটি তথ্য সামনে নিয়ে আসতে পারি। বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটির এক পর্যায়ে বলা হয়েছে, ‘‘যারা এ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদ — তারা বেশি শর্করা খেলেও শারীরিক পরিশ্রম বেশি করছেন বলে তা হজম হয়ে যাচ্ছে — কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না।’’
এ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদদের প্রতি আমরা কি কখনো লক্ষ্য করেছি? যদি আমরা পেশাদার এ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদদের খোঁজ নিই, আমরা দেখতে পাবো, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে যারা পেশাদারভাবে বিভিন্ন ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করছেন, তাদের কেউই ডায়াবেটিস দূরের কথা, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগেও আক্রান্ত নয়। এর কারণ কী? এরা সবাই কি চিনি বা মিষ্টান্ন থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকে? এরা কি শর্করাজাতীয় খাবার মোটেই খায় না বা খুব কম খায়?
সবই খায়। কিন্তু তবু ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয় না কেন? উত্তরটা প্রতিবেদনেই দেয়া হয়েছে, ‘‘তারা বেশি শর্করা খেলেও শারীরিক পরিশ্রম বেশি করছেন বলে তা হজম হয়ে যাচ্ছে — কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না’’। এটাই চিরন্তন সত্য কথা, এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতার কাছে চিনি—মিষ্টি বিরোধী সব বক্তব্য এবং গবেষণা ফলাফল ভুয়া প্রমাণিত হবে।
এ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদদের খোঁজ নেয়াটা সবার পক্ষে সহজ নয়। আমরা তাদের পরিবর্তে খোঁজ নিতে পারি ঐসব শ্রমজীবি লোকের, যারা পেশাদারভাবে কায়িক শ্রমনির্ভর কোনো না কোনো কাজ করে যাচ্ছেন ১৫—২০ বছরের বেশি সময় ধরে। সবাই নিজের আশেপাশে এই ধরনের অনেক লোক এখনো খুঁজে পাবেন। আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন লোক আছেন, যারা পেশা হিসেবে শারীরিক পরিশ্রমের বিভিন্ন কাজ (যেমন: কৃষিকাজ, স’মিলের কাজ, গাছকাটার কাজ, ইটভাটার কাজ, মাটিকাটার কাজ) করে থাকেন। এদের অনেকের অর্ধেক বয়সী অসংখ্য মানুষ যখন অহরহ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, তখন এরা ৫০—৬০ বছর বয়সে এসেও এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ! তারা সবাই কি চিনি—মিষ্টি এগিয়ে চলে? চলে না। তবু তারা এই রোগগুলোতে কেন আক্রান্ত হয় না? উত্তর সেই একটাই— ‘‘তারা বেশি শর্করা খেলেও শারীরিক পরিশ্রম বেশি করছেন বলে তা হজম হয়ে যাচ্ছে — কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না’’। পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম তাদের শরীেও চর্বি—কোলেস্টেরল জমতে দেয় না বলেই তারা এইসব রোগ থেকে নিরাপদ থাকছে।
মোটরচালিত রিকশার প্রচলনের পরও এখনো অনেক মানুষ পায়েচালিত রিকশা চালায়। ঢাকা শহরে আপনি এখনো পায়েচালিত রিকশা চালক পাবেন। আপনি এরকম ১০০ জন রিকশাচালকের খোঁজ নিন, যারা ১৫—২০ বছর ধরে কোনো বিরতি না দিয়ে পায়েচালিত রিকশা চালাচ্ছেন, দেখবেন এরা কেউই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত নন। কারণ কী? এরা কি মিষ্টি—চিনি থেকে সব সময় দূরে থাকে?
কারণ তা—ই, যা বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ্যাথলেট হোক, শ্রমজীবি মানুষ হোক, এরা নিয়মিত কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করার ফলে এদের শরীরে কোনো প্রকার চর্বি জমতে পারে না, বৃদ্ধি পাওয়া দূরের কথা; যা খায়, তা কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করার ফলে হজম হয়ে যায়, তাই এরা উচ্চ রক্তচাপেও আক্রান্ত হয় না, ডায়াবেটিসেও না, হৃদরোগেও না, যতদিন এরা এসব কাজ নিয়মিত করে থাকে। এদের অনেকেই চিনি বা মিষ্টি খেয়ে থাকেন নিয়মিত, এদের অনেকেই ধূমপানও করে থাকেন, এদের অনেকের বাবা—মা কেউ না কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল/আছে, তবুও এরা এই তিনটি রোগের কোনোটিতেই আক্রান্ত হয় না। কারণ এই তিনটি রোগ সমাজের ঐ সমস্ত লোককে বেছে বেছে আক্রমণ করে, যাদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বেশি, যারা শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে আরামে আরামে থাকতে পছন্দ করে। মানুষ চিনি বা মিষ্টান্ন বেশি কি কম খায়, নাকি মোটেই খায় না, তা কখনো বিবেচনায় রাখে না ডায়াবেটিসসহ এই তিনটি রোগ।
মানুষ চিনি—মিষ্টি না খেলেও যদি বেশি বেশি খাবার খায়, মনের পছন্দমতো খায় আর শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে, তখন মানুষের শরীরে চর্বি—কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাবেই। চিনি বা মিষ্টি খাওয়া বা না খাওয়ার সাথে শরীরে চর্বি বৃদ্ধি পাবার কোনো সম্পর্ক নেই। চিনি বা মিষ্টি পুরোপুরি বর্জন করার পরও মানুষ যদি শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে, যদি এনার্জি সঞ্চয়ের পর তা খরচ (বার্ণ) না করে, মানুষের শরীরে চর্বি—কোলেস্টেরল বেড়ে যাবেই; মানুষ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবেই।
হ্যাঁ, ডায়াবেটিসে কেউ আক্রান্ত হয়ে গেলে যদি চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার খায়, তখন ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। যেমন গরুর মাংস খাওয়া এলার্জির কোনো কারণ নয়। কিন্তু কারো এলার্জি হয়ে গেলে সে গরুর মাংস খেলে এলার্জি বেড়ে যায়।
‘ডায়াবেটিস নিয়ে যত ভুল’ শিরোনামে বাংলাদেশের জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির ওয়েবসাইটে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় ১৪ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে। সাক্ষাৎকারটিতে ডা. আবু সাঈদ শিমুল (রেজিস্ট্রার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘চিনি খেলে কখনো ডায়াবেটিস হয় না; তবে ডায়াবেটিস হয়ে গেলে অবশ্যই চিনি কম খেতে হবে বা একেবারে খাওয়া যাবে না।’’
বিষয়টা আশা করি সবার নিকট পরিষ্কার হয়ে গেছে। ‘চিনি বা মিষ্টি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, এমন মতামত যারা প্রকাশ করে, তারা বাস্তবতা থেকে অনেক অনেক দূরে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সাথেও চিনি—মিষ্টির খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ ক্যান্সারের কোনো কারণই এখনো পরিষ্কার হয়নি। যে যা—ই বলুক, ক্যান্সারের কোনো কারণ এখনও প্রমাণিত নয়। ক্যান্সারের যে কারণগুলো বেশি প্রচারিত, সেগুলোর সাথে বাস্তবতার দূরতম সম্পর্কও নেই। এই বিষয়ে ভিন্ন লেখায় আলোচনা করা হবে।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্ট অ্যাটাক এই রোগগুলোর জন্য চিনি—মিষ্টি খাওয়া মোটেই দায়ী নয়, দায়ী হচ্ছে আরামপ্রিয় জীবন যাপন করা, শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা। এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকতে হলে চিনি বা মিষ্টি খাওয়াকে নয়, বরং অলস বা আরামপ্রিয় জীবন যাপনকে ‘না’ বলতে হবে। নিয়মিত অন্তত ৪০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্ট অ্যাটাক কোনোভাবে আমাদেরকে আক্রমণ করতে পারবে না। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
নূর আহমদ
শিক্ষক; ফিটনেস বিষয়ক গবেষক ও লেখক