ডায়াবেটিস হওয়ার প্রকৃত কারণ এবং ডায়াবেটিস সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভুল কারণ
ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ এবং ডায়াবেটিস সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভুল কারণ
নূর আহমদ
ডায়াবেটিস একটি রোগ, একটি
আতঙ্কের নাম।ডায়াবেটিসে মানুষ কেন আক্রান্ত হয়, এটা এখনো অনেকের কাছে অজানা। শুধু এই
জন্য অনেক মানুষ ডায়াবেটিস থেকে বাঁচতে চেয়েওডায়াবেটিস থেকে বাঁচতে পারেন না, ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে অনেক
কথা প্রচলিত আছে। আজ এই বিষয়ে আলোচনা করবো।
ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে
যেসব ভুল তথ্য প্রচার করা হয়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, মিষ্টি খাওয়া, টেনশন করা,
বংশের কারো থাকা, ধূমপান করা, অতিরিক্ত কায়িক শ্রম করা, বয়স বেশি হওয়া ইত্যাদি।
বিশ্বের অসংখ্য মানুষ এই
বিষয়গুলোকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার জন্য দায়ী বলে বিশ্বাস করেন এবং অনেকে ডায়াবেটিস
থেকে নিরাপদ থাকার জন্য এই বিষয়গুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। কিন্তু লাভ হয় না। কারণ
এগুলো ডায়াবেটিসের কোনো কারণ নয়। ডায়াবেটিসের কারণ হিসেবে এগুলোকে ভুলভাবে প্রচার করা
হচ্ছে। অগভীর অধ্যয়ন ও গবেষণার ফলে ডায়াবেটিসের কারণ হিসেবে এই ভুল তথ্যগুলোর জন্ম
হয়েছে।
এগুলো যে ডায়াবেটিসের কোনো
কারণ নয়, তা জানার আগে আমাদের জানা দরকার, মানুষ ঠিক কোন কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
হয়।
ডায়াবেটিস হওয়ার প্রকৃত কারণ
আমি নিজেও একসময় ডায়াবেটিসের
কারণ নিয়ে অজ্ঞতায় ছিলাম। কিন্তু কাছের এবং পরিচিত অনেককে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে
দেখে আমার মনে একসময় ডায়াবেটিসের ভয় কাজ করতে শুরু করে। আমি নিজের প্রয়োজনেই ডায়াবেটিসের
কারণ নিয়ে পড়াশুনা করতে শুরু করি। ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন নিবন্ধ এবং গবেষণা
প্রতিবেদন পড়ে দেখেছি, ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে অনেক অনেক কথা প্রচার করা হয়। এগুলো
দেখে ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে আমি মারাত্মক বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। শেষে বাস্তবতার সাথে
ডায়াবেটিসের প্রচলিত কারণগুলোকে মেলাতে শুরু করি। ডায়াবেটিসের আক্রান্ত অনেকমানুষের
জীবনাচরণ সম্পর্কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের পরআশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করি, যেসব কারণকে
ডায়াবেটিসের জন্য সচরাচর দায়ী করা হয়, সেসব কারণগুলোর অনেকগুলোর সাথে বাস্তবতার কোনো
মিল নেই। ২০১৫ সালে এই বিষয়ে আমি একটি নিবন্ধ লিখি ‘অতিরিক্ত আরামই ব্যারামের কারণ’
শিরোনামে। নিবন্ধটি দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়।
বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ এবং
লেখালেখির এক পর্যায়ে ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ আমার নিকট সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে যায়।
আমার নিকট দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়, ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ হচ্ছে শারীরিক
পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা, আরামে আরামে জীবন যাপন করা, মনের চাহিদামতো খাওয়ার ফলে শরীরে
চর্বি কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া।
আরো পড়ুন: ক্যান্সারের প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি
দেখা যায়, অসংখ্য মানুষ বয়স
অনেক বেশি হয়ে যাবার পরও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না শুধুই নিয়মিত কায়িক শ্রম করে যাবার
কারণে। অথচ এরা মিষ্টি খেতে দ্বিধা করে না, অনেকে ধূমপানও করে, এদের অনেকের বাবা মা
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলো, এরা অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করে, এদের অনেকের জীবনে প্রচুর
টেনশন থাকে, এমনকি এদেরঅনেকের বয়স ৬০-৭০ বছর।তবু এরা ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকে।
অন্যদিকে আপনি দেখবেন, যারা
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার আগে কায়িক শ্রমের কোনো পেশায় নিযুক্ত
ছিল না বা নিয়মিত কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করতো না, মনের চাহিদামতো খেতো। দেখবেন, অনেক
কম বয়সী মানুষও এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি অনেক শিশুও।
আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয়, এমন বেশ কয়েকজনমানুষের খোঁজ নিলে দেখবেন, যারা ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত, তাদের প্রায় সবাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার আগে আরামে আরামে জীবন যাপন করতেন,
নিয়মিত কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করতেন না। আর যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন, দেখবেন তারা
কোনো না কোনোভাবে নিয়মিত কায়িক শ্রম করছেন, শরীর থেকে ঘাম ঝরাচ্ছেন।
আমাদের সমাজে অনেক শ্রমজীবি
মানুষ এখনো রয়েছে, যারা বিভিন্ন কায়িক শ্রমের পেশায় নিযুক্ত। কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি,
কৃষক, জেলে, কামার, কুমোর, পায়েচালিত রিকশাচালক এই সব পেশায় অনেক বছর ধরে লিপ্ত ২০-৩০
জনমানুষের খোঁজ নিন, আপনি অবাক হয়ে দেখবেন, এদের তেমন কেউই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন।
আমাদের যাদের বয়স ৫০ বছরের
মতো, আমরা দেখেছি, আমাদের ছোটবেলায় মানুষ এখনকার মতো আরামে থাকতে পারতো না। মানুষের
জীবনের অধিকাংশ কাজে প্রচুর কায়িক শ্রম ছিল। তখন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো একেবারে
কম। শুধুই কায়িক শ্রমে দিনের বেশিরভাগ সময় লিপ্ত থাকার কারণে মানুষ তখন ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত হতো না। কিন্তু এখন মানুষের জীবনে কায়িক শ্রম অনেক কমে যাবার কারণে মানুষ
এখন ব্যাপকহারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে।
ডায়াবেটিস শুধুই শরীরে কোলেস্টেরল
বেড়ে যাবার সুযোগে মানুষকে আক্রমণ করে। শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যাবার সবচেয়ে বড় কারণ
কায়িক শ্রম থেকে দূরে আরামে আরামে থাকা, আরো দুইটি কারণ হচ্ছে, মনের চাহিদামতো খাওয়া
এবং স্থূলতা।
এবার আমরা ডায়াবেটিস সম্পর্কে
প্রচলিত ভুল কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
মিষ্টি খেলে কি সত্যিই ডায়াবেটিস হয়?
প্রথমে আসি মিষ্টি খাওয়ার
সাথে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্পর্ক নিয়ে। মিষ্টি খাওয়ার সাথে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
হবার সম্পর্ক আছে বলে মনে করার একটা বড় কারণ হচ্ছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ চিনি,
মিষ্টি বা মিষ্টান্ন খেলে তাদের ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয়,
তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের এই বিষয়টা দেখে ভাবেন, যেহেতু মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস
বেড়ে যায়, তাই নিশ্চয়ই মিষ্টি খেলে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
আমরা প্রায় সবাই এই বিষয়টা
জানি, যারা এলার্জিতে আক্রান্ত, তারা বেগুন, ইলিশ মাছ, গরুর মাংস, চিংড়ি মাছ ইত্যাদি
খেলে তাদের এলার্জি বেড়ে যায়, কিন্তু এই খাবারগুলো খেলে যাদের এলার্জি নেই, তারা এলার্জিতে
আক্রান্তহয় না, তাদের শরীরে চুলকানি দেখা দেয় না। এই খাবারগুলো খাওয়ার সাথে যেভাবে
এলার্জিতে আক্রান্ত হবার কোনো সম্পর্ক নেই, সেভাবে মিষ্টি খাওয়ার সাথেও ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত হবার কোনো সম্পর্ক নেই। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস
বেড়ে যায়, কিন্তু যাদের ডায়াবেটিস নেই, তারা যতো মিষ্টিই খাক না কেন, তারা ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত হবে না, যদি তারা ডায়াবেটিস প্রতিরোধের সঠিক উপায় অবলম্বন করে।নিয়মিত কায়িক
শ্রম বা ব্যায়াম করে অথবা ডায়েট কন্ট্রোল করে, অথবা উভয়টা করে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে।
টেনশনে কি ডায়াবেটিস হয়?
টেনশনে ডায়াবেটিস হয় বলে
বিশ্বাস করা হয়। কিন্তু সমাজে এমন অনেক মানুষ আপনি খুঁজে পাবেন, যাদের জীবন টেনশনে
ভরপুর থাকা সত্ত্বেও তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। ৬০-৭০ বছর বয়সী অনেক মানুষকে
আমি চিনি, যারা এই বয়সে এসেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়নি।অথচ তাদের
অনেকের জীবনে প্রচুর টেনশন আছে বলে আমি জানি। আবার অনেক মানুষ এমন পাবেন,
যাদের জীবনে টেনশন তেমন নেই, যারা সুখী জীবন যাপন করা সত্ত্বেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
অনেকে অল্প বয়সেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন সুখী জীবন যাপন করা সত্ত্বেও। কেন?
টেনশনের সাথে ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত হবার কোনো সম্পর্ক নেই।ডায়াবেটিস প্রতিরোধের সঠিক উপায় অবলম্বন করলে মানুষেরজীবনটেনশনে
ভরপুর থাকলেও মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। আর ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কোনো উপায়
অবলম্বন না করলেটেনশন না করলেও মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এটাই হয়, এটাই বাস্তব।
ডায়াবেটিসকে আগে বড়লোকদের
রোগ বলা হতো। কেন জানেন? কারণ তখন বড়লোকরা ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হতো। আর বড়লোকদের
জীবনে গরীব মানুষদের চেয়ে টেনশন সাধারণত কম থাকে। টেনশন কম থাকা সত্ত্বেও, সুখী জীবন
যাপন করা সত্ত্বেও আগে বড়লোকরা ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হতো, কারণ তখন বড়লোকরা আরামে
থাকতো বেশি। নিজেদের কায়িক শ্রমের কাজগুলো কাজের লোক দিয়ে করাতো। তখন গরীব মানুষরা
ডায়াবেটিসে একেবারে কম আক্রান্ত হতো। কারণ তারা বিভিন্ন কায়িক শ্রমের কাজ করতো। কিন্তু
এখন? এখন বড়লোকদের পাশাপাশি গরীব মানুষরাও ব্যাপকহারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। কারণ
এখন অনেক গরীব মানুষও আরামে থাকে। মানুষের জীবনে এখন কায়িক শ্রম অনেক কমে গেছে। তাই
সমাজে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার হার এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। আগে পুরো গ্রাম খোঁজ
করলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ পাওয়া যেতো অল্প কয়জন, কিন্তু এখন প্রায় প্রতি ঘরেই
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ পাওয়া যায়।
টেনশনে মানুষ ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত হলে যারা সুখী জীবন যাপন করেন, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতেন না। আর যেসব
শ্রমজীবি মানুষ নিয়মিত কায়িক শ্রম করছেন, তারা খুব কমই ডায়াবেটিস থেকে বেঁচে থাকতেন।
কারণ তাদের প্রায় সবার জীবন নানা রকম টেনশনে ভরপুর থাকে। অভাব, ঋণ, সাংসারিক নানা টানাপোড়েনে,
পিছুটানে তারা জর্জরিত থাকেন।
ধূমপানে কি ডায়াবেটিস হয়?
ধূমপানকেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
হবার জন্য দায়ী করতে দেখা যায়। ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে প্রকাশিত প্রায় প্রতিটা নিবন্ধে
ডায়াবেটিসের কারণ হিসেবে ধূমপানকেও উল্লেখ করা হয়। যার কোনো ভিত্তি নেই। বাংলাদেশে
মহিলারা এবং ধার্মিকমানুষরা ধূমপান থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও ডায়াবেটিসে ব্যাপকহারে
আক্রান্ত হয়ে থাকেন। অন্যদিকে যারা নিয়মিত ঘামঝরানো কায়িক শ্রম করেন, তাদের অনেকেই
ধূমপান করা সত্ত্বেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন না। এই দুইটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করলেই
পরিষ্কার হয়, ধূমপানের সাথে শুধুডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু ডায়াবেটিস
নয়, ধূমপানের সাথে ক্যান্সার, ব্রেইন স্ট্র্রোক বা উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি কোনো রোগে
আক্রান্ত হবারও কোনো সম্পর্ক নেই। ধূমপানে মূলত কোনো রোগই হয় না।ধূমপান একটা নন্দঘোষ।
যে কোনো রোগে আক্রান্ত মানুষ যদি ধূমপান করে, ওই রোগে আক্রান্ত হবার জন্য ধূমপানকে
সবচেয়ে বড় কারণ বলে গণ্য করা হয়।দেখুন (১) বয়স ৬০-৭০ বা ৮০ বছর হয়ে যাবার পরও যারা
কায়িক শ্রমে লিপ্ত থাকে, তারা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয় না।
(২)অন্যদিকে৩০-৪০ বছর ধরে একটানা ধূমপান করা সত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্যান্সার এবং
ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার সুযোগ পায়। ধূমপানে এসব
রোগ হলে এই দুই রকম ঘটনা এতো ব্যাপকহারে ঘটতো না।
ডায়াবেটিস কি সত্যিই বংশগত রোগ?
বংশের কারো থাকার সাথে ডায়াবেটিসের
প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে বলে সারা বিশ্বেই বিশ্বাস করা হয়। আমরা যারা ডায়াবেটিসের পরিসংখ্যানের
দিকে লক্ষ করি না, তারাই ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে বিশ্বাস করি। আপনি ডায়াবেটিসের
পরিসংখ্যান দেখুন। দেখবেন, ১৯৬০ সালের আগে পৃথিবীতে মানুষের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার
হার অনেক কম ছিল।
এমন লক্ষ লক্ষ পরিবারে এখন
এক বা একাধিক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যেসব পরিবারে ১৯৫০ সালের আগে কারো ডায়াবেটিস
ছিল না। দিন যতোই যাচ্ছে, মানুষ ততো ব্যাপকহারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। কেন এখন
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার হার ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে? একটাই কারণ। এখন মানুষের
জীবন থেকে কায়িক শ্রম দ্রুতগতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন আরামে থাকার প্রবণতা বাড়ছে,
মানুষের জীবনচলার পথ এখন আগের চেয়ে বহুগুণে আরামদায়ক হয়ে গেছে; আরাম-বান্ধব প্রযুক্তিতে
এখন পৃথিবী সয়লাব। দিনকে দিন নতুন নতুন ক্ষেত্রে আরাম-বান্ধব প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে।
শুধু আরামের দিকে ঝুঁকে যাবার কারণে মানুষকে এখন ব্যাপকহারে আক্রমণ করছে ডায়াবেটিস।
যেসব পরিবারে আগে কারো ডায়াবেটিস
ছিল না, সেসব পরিবারে এখন ডায়াবেটিস কোত্থেকে জন্ম নিল?শুধুই আরামে আরামে থাকা থেকে।
এখনো যেসব পরিবারে কারো ডায়াবেটিস নেই, সেসব পরিবারে কেউ কি ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
হবে না? অবশ্যই হবে। কারণ এখন আরামে আরামে থাকার যুগ। এখনো বাবা-মায়ের আগে সন্তানের
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু সামনে এমন ঘটনাঘটার সুযোগও
কমে যাবে। কারণ ডায়াবেটিস এখন যেভাবে পরিবারের প্রতিটা সদস্যকে টার্গেট করতে শুরু করছে,
ভবিষ্যতে বাবা মায়ের ডায়াবেটিস ছিল না, এমন সন্তান খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়বে।
কোনো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
রোগী ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার রোগীকে অনেক সময় জিজ্ঞেস করেন, ‘‘আপনার বাবা-মা কেউ
কি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল?’’ রোগী ‘‘হ্যাঁ’’ বললেই ডাক্তার আর কোনো কিছু বিবেচনা
না করে ওই রোগীর ডায়াবেটিসকে বংশগতভাবে হয়েছে বলে মন্তব্য করে। কিন্তু ডাক্তার কখনো
রোগীকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করেন না, ‘‘আপনার দাদা-দাদী এবং নানা-নানীরও কি ডায়াবেটিস ছিল?’’
এই প্রশ্ন যদি করতো, অধিকাংশ
রোগী উত্তরে বলতো, ‘‘ছিল না’’। যদি দাদা-দাদী বা নানা-নানীর ডায়াবেটিস না থাকা সত্ত্বেও
কারোবাবা-মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে, তাহলে ওই সন্তানের বাবা-মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
না হলে সে কি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারতো না?কেন বাবা-মায়ের ডায়াবেটিসকে সন্তানের
ডায়াবেটিসের সাথে সম্পর্কিত করা হচ্ছে?বাবা-মায়ের ডায়াবেটিসের ব্যাপারে কেন দাদা-দাদী
বা নানা-নানীর ডায়াবেটিসের খোঁজ নেয়া হয় না?
ডায়াবেটিসের মূল কারণ কারণ
হচ্ছে, আরামে আরামে জীবন যাপন করা। বাবা-মা যদি আরামে জীবন যাপন করার কারণে ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত হতে পারে, সন্তান কেন আরামে আরামে থাকলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবে না? বাবা-মা
বা পূর্বপুরুষ সবাইডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকলেও সন্তান যদি নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে
কায়িক শ্রম করে, সন্তান কখনোই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবে না, যতোদিন নিয়মিত কায়িক শ্রমে
নিযুক্ত থাকবে। ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই মানুষ ডায়াবেটিসকে
বংশগত রোগ বলে ভুল করছে। এই অজ্ঞতা আমাদের ক্ষতি করছে।
দেখতে হবে সন্তান নিয়মিত
পর্যাপ্ত পরিমাণে কায়িক শ্রম করা সত্ত্বেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছে কিনা? যদি সন্তান
নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে কায়িক শ্রম করা সত্ত্বেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়, তখন সন্তানের
ডায়াবেটিসকে বংশগতভাবে হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। কিন্তু এমন ঘটনা কখনো ঘটবে না।
কারণ মানুষ নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘাম ঝরানো কায়িক শ্রম করলে বাবা-মা বা পূর্বপুরুষ
সবার ডায়াবেটিস থাকলেও সন্তান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না।
অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমে কি ডায়াবেটিস হয়?
অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমেও
ডায়াবেটিস হয় বলে প্রচার করা হয়। এটা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর কথা। আপনি দেখবেন, আগে
মানুষ পায়েচালিত রিকশা চালাতো। তখন রাস্তাঘাটও কাঁচা ছিল। কাঁচা রাস্তায় যাত্রী, মালামাল
এসব নিয়ে পায়েচালিত রিকশা চালানোটা যথেষ্ট শারীরিক পরিশ্রমের কাজ ছিল। কিন্তু বছরের
পর বছর ধরে এমন হাড়ভাঙ্গা শারীরিক পরিশ্রম করা সত্ত্বেও তখন রিকশাচালকরা ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত হতো না। এখনো অনেক মানুষ বিভিন্ন কায়িক শ্রমের কাজ করতে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে
ফেলে। তবু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না, বরং ডায়াবেটিস থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকে।এটাই
বাস্তব যে, মানুষ ঘামঝরানো কায়িক শ্রম যতো বেশি করে, ডায়াবেটিস থেকে ততো বেশি নিরাপদ
থাকে।
বয়স বেশি হওয়া কি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার একটি কারণ?
বয়স বেশি হলে মানুষ এমনিতেই
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বলে অনেক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়। ডায়াবেটিসের কারণ হিসেবে চল্লিশোর্ধ
বা পঞ্চাশোর্ধ বয়স হওয়াকে দায়ী করার ‘সুযোগ’ আগে থাকলেও এখন একেবারে নেই। কারণ আগে
শেষ বয়সে কিছু কিছু মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেও এখন শুধু বেশি বয়সীরা নয়, কম বয়সীরাও
ব্যাপকহারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু যুবকরা নয়, শিশুরাও এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
হচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ আগে মানুষ ৬০-৭০ বছর বয়সে এসেও বিভিন্ন কায়িক শ্রম করতো।
শেষ বয়সে কেউ কেউ কায়িক শ্রমে অপারগ হয়ে যাবার কারণে বা এমনিতেই কায়িক শ্রম থেকে অবসরে
চলে যাবার কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো। কিন্তু এখন মধ্যবয়ীরা নয়, যুবকরাও কায়িক
শ্রমকে বয়কট করার চেষ্টা করছে, অনেক শিশুও কায়িক শ্রমের সুযোগ পাচ্ছে না বা কায়িক শ্রম
করছে না। তাই ডায়াবেটিস এখন‘কায়িক শ্রম থেকে অবসরে চলে যাওয়া বয়স্ক’দের পাশাপাশি যারাই,
যে বয়সেই কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকছে, তাদেরকে ধরে ধরে আক্রমণ করছে। এই জন্য অনেক শিশুকেও
এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষ এখন ব্যাপকহারে
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে শুধু আরামের পেশায় চলে যাবার কারণে, শুয়ে বসে ২৪ ঘন্টা কাটিয়ে
দেয়ার কারণে।
ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার উপায়
ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে
সঠিক ধারণার অভাবেই বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। আপনি শুধু
নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘাম ঝরানো কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করুন, অথবা ডায়েট কন্ট্রোল
করুন, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন, শরীরে যাতে চর্বি কোলেস্টেরল বেড়ে যেতে না
পারে, সেই চেষ্টা করুন। আপনি শুধু ডায়াবেটিস থেকে নয়, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্ট অ্যাটাক থেকেও সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবেন।
নূর আহমদ
শিক্ষক; কলামিস্ট ও ফিটনেস বিষয়ে অধ্যয়নরত।