ডায়াবেটিস কি সত্যিই বংশগত রোগ?
ডায়াবেটিস কি সত্যিই বংশগত রোগ?
নূর আহমদ
‘ডায়াবেটিস বংশগতভাবেও হয়’ প্রচলিত এই ধারণা বা বিশ্বাস বিশ্বব্যাপী মানুষের ক্ষতি করে যাচ্ছে ভয়াবহভাবে। ব্যাপকহারে প্রচারের কারণে অসংখ্য মানুষ এখন বিশ্বাস করছে, ডায়াবেটিস একটি বংশগত বা জিনগত রোগ। বাপ—দাদা বা মা—নানী অথবা পূর্বপুরুষদের কারো ডায়াবেটিস থাকলে সন্তানও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
কিভাবে প্রচারিত হয়েছে? কেউ ডায়াবেটিস রোগ নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে অনেক ডাক্তার রোগীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার বাবা মা বা বংশের কারো কি ডায়াবেটিস ছিল?’ রোগী ‘হ্যঁা’ বললেই হলো, ঐ রোগীর ডায়াবেটিসকে বংশগত বলে মন্তব্য করতে ডাক্তার দ্বিতীয়বার ভাববার প্রয়োজন মনে করেন না।
বংশের কারো ডায়াবেটিস থাকলেই সন্তান সেই ডায়াবেটিসের উত্তরাধিকার হয়ে যায়, ডাক্তারদের এই মন্তব্য আমাদের সহজেই বিশ্বাস হয়ে যায়। প্রথম কারণ, কথাটা বলেছেন একজন ডাক্তার। আর ডাক্তাররা অবশ্যই আমাদের চেয়ে এই বিষয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন। দ্বিতীয় কারণ, বংশগতভাবেও মানুষ অনেক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকার কথা সত্য।
আমরা ডায়াবেটিস সম্পর্কে ডাক্তারদের এমন মন্তব্যের যৌক্তিকতা যাচাইয়ের আগে দেখে নিই কোন কোন রোগ বাবা—মা থেকে সন্তানের শরীরে সংক্রমিত হয় এবং কখন একটি রোগ বাবা—মার শরীর থেকে সন্তানের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে?
বংশগত রোগ কোনগুলো?
সাধারণত বাত—ব্যথাজনিত রোগ, অ্যালার্জি বা চুলকানিজনিত রোগ এবং ক্যান্সার এসব রোগ বাবা—মায়ের শরীর থেকে সন্তানের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। কারণ এই রোগগুলো রক্তের মধ্যে সৃষ্টি হবার কারণে এগুলো রক্তবাহিত। বিশেষ করে বাত বা আর্থারাইটিস এবং অ্যালার্জিজাতীয় রোগগুলো রক্তদুষ্টিজনিত। আর ক্যান্সারও রক্তের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। এজন্য বাবা—মা কেউ এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হলে সন্তানও এই রোগগুলোর উত্তরাধিকারী হতে পারে। কিন্তু সব সময় বা সব ক্ষেত্রে নয়। এক্ষেত্রে একটা শর্ত আছে। শর্তটি হলো: সন্তান মায়ের গর্ভে আসার সময় থেকে ভুমিষ্ট হওয়া এবং মাতৃদুগ্ধ পান কালীন সময় পর্যন্ত যদি বাবা—মা দুজনের যে কেউ এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তখন সন্তানের শরীরেও এই রোগগুলো ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর যদি সন্তান জন্ম এবং মাতৃদুগ্ধ খাওয়ার পর বাবা/মা কেউ এই রোগগুলোর কোনোটিতে আক্রান্ত হন, তাহলে সন্তানের শরীরে এই রোগগুলো সংক্রমিত হবার কোনো সযোগও নেই, সম্ভাবনাও নেই। ধরুন, আপনার বাবা বা মা আপনার জন্মের পাঁচ বছর পর এলার্জি—জাতীয় কোনো রোগে আক্রান্ত হলো। আপনার বাবা/মায়ের শরীর থেকে ঐ রোগ আপনার শরীরে কিভাবে আসবে? যদি আসতে পারে, তাহলে কোন সূত্রে আসবে? একই ঘরে থাকার কারণে? যদি তা—ই হয়, তাহলে রোগটি আপনার বাবা—মা কারো না হয়ে যদি আপনার কোনো ভাই বা বোনের হয়, তাহলেও আপনার শরীরে আসতে পারে। আপনার কর্মস্থলের কোনো সহকর্মীর রোগটি থাকলেও তা আপনার শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। কিন্তু এমন কি কখনো হয়? এটা কি সম্ভব? আপনি কি কখনো শুনেছেন, কোনো রোগ মানুষের বাবা—মায়ের শরীর থেকে মানুষের শরীরে যেমন ছড়ায়, ভাই—বোন এবং আশপাশে থাকা মানুষদের শরীর থেকেও ছড়ায়? শুনেননি। কারণ এটা সম্ভব নয়।
আরো পড়ুন: ওজন বাড়ে কেন? ওজন কমানোর সঠিক উপায়
আপনার সন্তান জন্মের পর আপনার শরীরে যে রোগ জন্ম নিয়েছে, সেই রোগ আপনার সন্তানের শরীরে সংক্রমিত হবে কোত্থেকে? শুধুমাত্র সন্তান গর্ভধারণের সময় থেকে সন্তান মাতৃদুগ্ধ পান করা পর্যন্ত সময়ে বাবা—মা কোনো রক্তবাহিত রোগে আক্রান্ত থাকলে সন্তানের শরীরে সেই রোগ সংক্রমিত হতে পারে।
ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলা অযৌক্তিক
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে এই সূত্রের কথা ডাক্তারদের মাথায় মোটেই থাকে না। হয়তোবা অনেক ডাক্তারের এই সূত্রের কথা জানাও নেই। ধরুন, আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন ৪০ বছর বয়সে। আপনার বাবা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ১০ বছর আগে, যখন আপনার বয়স ছিল ৩০ বছর। আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে কোনো ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার আপনাকে জিজ্ঞেস করে যখন জানতে পারলেন, আপনার বাবারও ডায়াবেটিস ছিল, তখন আপনার ডায়াবেটিসকে বংশগত ডায়াবেটিস বলে মন্তব্য করার কোনো সুযোগ থাকে? এখন আপনি বলুন আপনার জন্মের সময় বা আপনি মাতৃদুগ্ধ পান করা পর্যন্ত সময়ে যেই রোগটি আপনার বাবা/মা কারো ছিল না, এমনকি আপনার জন্মের এক—দুই বছর পরেও নয়, ৩০ বছর পরে আপনার বাবা/মা যেই রোগে আক্রান্ত হলেন, সেই রোগ আপনার শরীরে কিভাবে সংক্রমিত হবে?
আপনার জন্মের ৩০ বছর পর আপনার বাবা যেই কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন, আপনিও আপনার ৪০ বছর বয়সে এসে সেই কারণেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া কি অসম্ভব? কেন আমরা এটাকে অসম্ভব মনে করি? আপনার ডায়াবেটিস আপনার বাবার ডায়াবেটিসের উত্তরাধিকার হতে যাবে কেন? এটাকে অসম্ভব মনে করার কারণেই যত বিপত্তি। একটি রোগ নির্দিষ্ট কারণে শুধু এক প্রজন্মকেই আক্রমণ করতে পারে, এই অজ্ঞতাপূর্ণ বিশ্বাস থেকেই বংশগত রোগের ধারণা অস্তিত্ব লাভ করেছে। ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে এই অজ্ঞতাপূর্ণ বিশ্বাস ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।
এমন অনেক ঘটনাও ঘটে, একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত লোকের দাদা—দাদী বা নানা—নানী কারো ডায়াবেটিস ছিল না, কিন্তু তার বাবা—মা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল। সেসব ক্ষেত্রেও কিন্তু সন্তানের ডায়াবেটিসকে বাবা—মায়ের ডায়াবেটিসের সাথে সম্পর্কিত করা হয় কোনো কিছু বিবেচনা করা ছাড়াই। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, যেই লোকের ডায়াবেটিসকে তার বাবার ডায়াবেটিস থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করা হয়, খুঁজে দেখা হয় না, তার বাবার ডায়াবেটিসও কি তার দাদা—দাদী কারো থেকে প্রাপ্ত? তার বাবার ডায়াবেটিস যদি বংশগত কারণ ছাড়া অন্য কোনো কারণে হতে পারে, তার ডায়াবেটিসও কি সেরকম কোনো কারণে হতে পারে না? অবশ্যই পারে। তবু কেন শুধু শুধু মানুষের ডায়াবেটিসকে তার পূর্বপুরুষের ডায়াবেটিসের সাথে সম্পর্কিত করা হয়? এই ‘সম্পর্কিত করা’র ক্ষতি কত মারাত্মক, তা জানলে যে কেউ অবাক হয়ে যাবে।
ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করা দুই দিক থেকে ক্ষতিকর
ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করার কারণে দুই দিক থেকে মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। (১) যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয় এবং যাদের বাবা/মা কারো ডায়াবেটিস ছিল না, তারা ভাবে, আমার বাবা/মা কারো যেহেতু ডায়াবেটিস ছিল না, আমিও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবো না। এটা ভেবে তারা ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কোনো উপায় অবলম্বন করে না। একসময় তারাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে ঐ কারণে, যেই কারণে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। এভাবে তারা মারাত্মকভাবে বিভ্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। (২) অপরদিকে যাদের বাবা/মা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, তারা ভাবে, যেহেতু আমার বাবা/মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, আমিও ডায়াবেটিসে অবশ্যই আক্রান্ত হবো, ডায়াবেটিস থেকে আমার রক্ষা পাবার কোনো সুযোগ নেই। এটা ভেবে তারাও হাত—পা ছেড়ে বসে থাকে, ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কোনো উপায় অবলম্বন করে না। একসময় তারাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে ঐ কারণে, সত্যিকারার্থে যেই কারণে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
ডায়াবেটিস আক্রান্ত হবার সত্যিকারের কারণ
ডায়াবেটিস আক্রান্ত হবার সত্যিকারের কারণ হলো শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা, আরামপ্রিয় জীবন যাপন করা, শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া। এজন্য আগে, যখন মানুষের জীবনে পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম ছিল, তখন মানুষ ডায়াবেটিসে একেবারে কম আক্রান্ত হতো। কিন্তু এখন, মানুষের জীবন থেকে কায়িক শ্রম দূরে সরে যাচ্ছে দিন দিন, তাই এখন মানুষ ব্যাপকহারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে।
কিন্তু এসবের মধ্যেও এখনও কিছু মানুষ নিয়মিত কায়িক শ্রম করছে বিভিন্নভাবে, দেখবেন তারা সহজে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে না। বিশেষ করে কায়িক শ্রমের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষগুলোকে দেখবেন, বয়স অনেক বেশি হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তারা ডায়াবেটিসে তেমন আক্রান্ত হয় না।
ডায়াবেটিসকে বংশগত বলে প্রচার করার আরও একটি ক্ষতি
ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করার কারণে মানুষ আরো এক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বাবা—মা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল না, এমন অনেকে এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস যে কোনো বংশগত রোগ নয়, এখনও তার উদাহরণ দেয়া যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের জীবন থেকে কায়িক শ্রম দিন দিন দূরে সরে যাবার কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার সমাজে যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, একটা সময় আসবে যখন সবাই দেথবে, সবার বাবা—মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল। ডায়াবেটিস যে কোনো বংশগত রোগ নয়, তখন এই কথার পক্ষে কোনো বাস্তব উদাহরণ দেয়া সম্ভব হবে না।
এখনও এটা প্রমাণ করার সুযোগ আছে, ‘‘ডায়াবেটিস আরামপ্রিয় মানুষের রোগ’’। সময় থাকতে যদি ডায়াবেটিস সম্পর্কে ভুল বিশ্বাস প্রচার বন্ধ করে সঠিক বিশ্বাস প্রচার শুরু করা না হয়, দুই—দিন দশক পর ‘‘ডায়াবেটিস বংশগত রোগ’’ এই ‘ভুল বিশ্বাস’ চূড়ান্তভাবে একটি ‘সঠিক বিশ্বাসে’ পরিণত হবে, সন্দেহ নেই।
মূলত ডায়াবেটিস বংশগতভাবে হতে পারে ঐসব লোকের, যারা জন্মের আগে বা মাতৃদুগ্ধ পান শেষ হবার আগে তাদের বাবা—মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল। আর অন্য যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়, তারা সবাই আক্রান্ত হয় শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকার কারণে শরীরে চর্বি বেড়ে গিয়ে।
ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা পেতে করণীয়
তাই ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা পেতে হলে বাবা—মা কারো ছিল, নাকি ছিল না, তা না দেখে দেখতে হবে, আমি নিয়মিত পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করছি কিনা?
যদি না করে থাকি, তাহলে ডায়াবেটিস আমাকে ধরবেই, কোনো রক্ষা নেই, যদি আরামে আরামেই জীবন কাটাই, আমার পূর্বপুরুষদের কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হয়ে থাকে, তবুও।
পূর্বপুরুষদের অনেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেও সন্তান যতদিন নিয়মিত পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম করবে, ততদিন ডায়াবেটিস থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম থেকে দূরে থাকলে ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার সুযোগ একেবারে কম। নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করলে ডায়াবেটিস কোনোভাবে মানুষকে আক্রমণ করতে পারে না। আসুন, ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকার জন্য নিয়মিত ৪০ মিনিটের মতো সময় কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করি।