ধূমপান কি সত্যিই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর? ধূমপানে কি সত্যিই ক্যান্সার হয়?

ধূমপান কি সত্যিই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর? ধূমপানে কি সত্যিই ক্যান্সার হয়?

নূর আহমদ

ধূমপানে কি সত্যিই স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়? ধূমপানে কি সত্যিই শরীরে কোনো রোগ হয়? ধূম পান, নাকি তামাক সেবন ক্ষতিকর, নাকি কোনোটিই ক্ষতিকর নয়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবতে অসুবিধা কোথায়! নিচে উল্লেখিত ২৩টি পয়েন্টে রেফারেন্সের চেয়ে যুক্তি বেশি। আপনি যদি মুক্ত চিন্তার মানুষ হন, তাহলে এই ২৩টি পয়েন্ট মনোযোগসহ পড়া শেষে ধূমপান নিয়ে আপনার সনাতন বিশ্বাসে সামান্য হলেও ফাটল ধরবেই।


ধূমপান কি সত্যিই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?


১. পৃথিবীতে এমন কোনো রোগ নেই, যাতে শুধু ধূমপায়ীরাই আক্রান্ত হয়

ধূমপানে যদি কোনো রোগ হতো, তাহলে কেবল ধূমপায়ীরাই সেই রোগে আক্রান্ত হতো, অধূমপায়ীরা কখনো সেই রোগে আক্রান্ত হতো না। কিন্তু এমন কোনো রোগে কি মানুষ আক্রান্ত হয়, যাতে কেবল ধূমপায়ীরাই আক্রান্ত হয়, অন্যরা নয়? নেই। আপনি—ই বলুন, অধূমপায়ীরা যেই কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, ধূমপায়ীরাও কি সেই একই কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে না? অধূমপায়ীরা যেই কারণে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়, ধূমপায়ীরাও কি সেই কারণেই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে পারে না?

আমার পরিচিত ও কাছের অনেক মানুষকে দেখেছি হার্ট অ্যাটাকে (হৃদরোগ) আক্রান্ত হতে, যারা কখনোই ধূমপান করেন না। তারা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন শুধুই শরীরে চর্বি—কোলেস্টেরল বেড়ে যাবার কারণে। আর তাদের শরীরে চর্বি—কোলেস্টেরল বেড়ে যাবার প্রধান কারণ হচ্ছে তাঁরা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকতেন বেশি। অথচ ধূমপায়ীরাও এই একই কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য প্রথমেই ধূমপানকে দায়ী করা হয়। শুধু হৃদরোগ নয়, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার জন্যেও ধূমপান মোটেই দায়ী নয়। আমার এই সংক্রান্ত বিভিন্ন লেখায় আমি এটা প্রমাণ করেছি। এই তিনটি রোগের জন্য ধূমপানকে দায়ী করাটা চরম ভুল। বাকি থাকে ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোক। সেই দুইটি রোগ কি তাহলে ধূমপান করার কারণেই হয়ে থাকে?

২. বাংলাদেশে মহিলারা, মাদ্রাসা শিক্ষিতরা এবং শিশুরা ধূমপান না করা সত্ত্বেও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়

বাংলাদেশে মহিলারা সচরাচর ধূমপান করেন না। উপজাতি মহিলাদের কেউ কেউ এবং কিছু কিছু ভার্সিটির উঠতি বয়সী অনেক মেয়ে ধূমপান করে থাকে। কিন্তু শতকরা কত জন মহিলা ধূমপায়ী, সেই হারে সেগুলো কোনো প্রভাব ফেলবে না। তাই বলা যায়, বাংলাদেশে শতকরা একজন মহিলাও ধূমপায়ী নয়। মহিলারা ছাড়াও মাদ্রাসা শিক্ষিতরা এবং শিশুরা ধূমপান থেকে দূরে থাকার পরও কি ক্যান্সার থেকে নিস্তার পায়? কোনোভাবেই না। তাহলে ধূমপানকে ক্যান্সারের জন্য দায়ী করার কী অর্থ? এই তিন শ্রেণির মানুষ ধূমপান না করা সত্ত্বেও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, ধূমপায়ী ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষগুলো ধূমপান না করলে কি ক্যান্সার থেকে রেহাই পেতো?  এটার নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবে?

৩. শুধু ধূমপায়ীরা নয়, মহিলা এবং মাদ্রাসা শিক্ষিতরাও সচরাচর ব্রেইন স্ট্র্রোকে আক্রান্ত হয়

আর ব্রেইন স্ট্রোকে কি শুধু ধূমপায়ীরা আক্রান্ত হয়? মহিলা এবং মাদ্রাসা শিক্ষিতরাও অহরহ ব্রেইন স্ট্র্রোকে আক্রান্ত হয়? ব্রেইন স্ট্রোকের চিকিৎসা করা হয়, এমন কোনো হাসপাতালে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত মানুষদের উপর জরিপ চালালেই দখো যাবে, শুধু ধূমপায়ীরা নয়, সম্পূর্ণ অধূমপায়ী এই দুই শ্রেণিও প্রায় সমান হারে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। এই দুই শ্রেণি ছাড়া অন্য অধূমপায়ী মানুষরাও ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। ধূমপান থেকে দূরে থাকা মানুষ যেই কারণে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, ধূমপায়ী ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্তরা সেই কারণে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত না হয়ে ধূমপানেই ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, এটা কি কেউ প্রমাণ করতে পারবে?

৪. পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ ধূমপায়ী মানুষ ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াই মারা যায়

আপনার আমার সামনে আমাদের পরিচিত অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে, যারা জীবনের বেশির ভাগ সময় ধূমপান করেছেন, কিন্তু ক্যান্সার বা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত  হওয়া ছাড়াই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। এটা কখনো সম্ভব হতো না, যদি ধূমপানে মানুষ সত্যিই এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হতো! কারণ এক দুই দিন নয়, এক দুই বছরও নয়, ত্রিশ—চল্লিশ বছর ধরে একটানা ধূমপান করা সত্ত্বেও যদি রোগ দুইটিতে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াই লক্ষ লক্ষ মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারে, তাহলে ধূমপানকে এই রোগগুলোর জন্য দায়ী করার সুযোগ কোথায়! অথচ এই রোগগুলোর জন্য ধূমপানকে এমনভাবে দায়ী করা হয়, যেন যারা ধূমপান করে, তারা এই রোগ দুইটি থেকে বেঁচে যাবার কোনো সুযোগ নেই!

৫. একজন লোক কয় লক্ষ সিগারেট খেলে ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়?

বর্তমান বিশ্বে এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে দৈনিক ২০টির মতো সিগারেট খেয়ে আসছে, কিন্তু এখনো ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকের দুইটি বা একটিতেও আক্রান্ত হয়নি। একজন লোক যদি দৈনিক ২০টির মতো সিগারেট খায়, তাহলে ৩০ বছরে সে কতগুলো সিগারেট খায়? হিসাবটি হচ্ছে, ২০*৩৬৫=৭৩০০*৩০=২১৯০০০। অর্থাৎ ত্রিশ বছরে প্রায় দুই লক্ষ বিশ হাজার সিগারেট খেয়েও যদি লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকের কোনেটিতেই আক্রান্ত না হয়ে থাকেন, তাহলে প্রশ্ন জাগে একজন লোক কয় লক্ষ সিগারেট খেলে এসব রোগে আক্রান্ত হয়?

শুধু ৩০ বছর ধরে নয়, ৪০—৫০ বছর ধরে দৈনিক ২০টির মতো সিগারেট খাওয়া হাজার হাজার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা এখনো ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকের কোনেটিতেই আক্রান্ত হয়নি! এটা অবশ্যই অবাক হবার কথা হতো, যদি ধূমপানে মানুষ সত্যিই এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হতো।

৬. ৬৫ বছর ধরে ধূমপান করছেন, এমন একজন লোকের সাক্ষাৎকার

আমাদের এলাকায় একজন লোক আছেন সুলতান নামে। তিনি নিয়মিত ধূমপান করেন।  ২০১৯ সালের কোনো এক সময় আমি একদিন তাঁর সাথে কথা বলতে গিয়ে কথায় কথায় ধূমপানের প্রসঙ্গে চলে যাই। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘‘আপনি কত বছর ধরে ধূমপান করছেন?’’ তিনি উত্তর দেন, ‘‘আমি যত বছর ধরে রিকশা চালাচ্ছি, তত বছর ধরেই ধূমপান করি।’’ আমি প্রশ্ন করি, ‘‘আপনি কত বছর ধরে রিকশা চালান?’’ তিনি বলেন, ‘‘৬৫ বছর ধরে।’’ আমি প্রশ্ন করি, ‘‘আপনার কি হাই প্রেসার বা ডায়াবেটিস আছে?’’ তিনি বললেন, ‘‘নেই।’’ হৃদরোগ তো নেই—ই। আর ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকেও তিনি এখনো আক্রান্ত হননি। তিনি ৬৫ বছর ধরে নিয়মিত ‘পায়েচালিত’ রিকশা চালানোর ফলেই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাক তাঁকে আক্রমণ করতে পারেনি। আর ৬৫ বছর ধূমপান করার পরও এখনো তিনি ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হননি। তিনি এখনো (০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২) জীবিত আছেন। তিনি আরো কতো আগেই এই দুইটি রোগে আক্রান্ত হতেন, যদি ধূমপান সত্যিই এই রোগ দুইটির কারণ হতো।

৭. যেসব দেশে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলো ধূমপান

পৃথিবীর হাতে গোনা কিছু দেশে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন ভুটান, তুর্কমেনিস্তান। নিউজিল্যান্ড ধূমপান নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে। ভুটান এবং তুর্কমেনিস্তানের মানুষ কি এখন ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকসহ যেই রোগগুলোকে ধূমপানসৃষ্ট বলা হয়, সেই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয় না? খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখা যাবে এখনো এই দেশগুলোর মানুষ ওই রোগগুলোতে আগের মতোই আক্রান্ত হয়। কারণ এই রোগগুলোর সাথে ধূমপানের কোনো সম্পর্ক নেই।

৮. পৃথিবী থেকে ধূমপান এবং তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হলে কী হবে?

কিছুই হবে না। বর্তমান বিশ্বে ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার যে হার, তাতে তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না। আর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হবার হার বরং আরো বেড়ে যাবে। কেন বেড়ে যাবে? কারণ মানুষ দিন দিন কায়িক শ্রম থেকে দূরেই সরে যাচ্ছে। তাই ধূমপানকে পৃথিবী থেকে দূর করা হোক বা না হোক, এই রোগ তিনটিতে আক্রান্ত হবার হার দিন দিন শুধু বৃদ্ধিই পাবে, কোনোভাবে কমবে না।

পৃথিবী থেকে বা কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা কোনো দ্বীপ থেকে যদি বিড়ি—সিগারেট এবং তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, আমদানি, ক্রয়—বিক্রয় এবং ব্যবহার সম্পূর্ণ দূর করে দেয়া হয়, তাতে পৃথিবী বা ওই অঞ্চল বা ওই দ্বীপের মানুষ কি ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকসহ যেই রোগগুলোকে ধূমপানসৃষ্ট বলা হয়, সেই রোগগুলো থেকে নিরাপদ হয়ে যাবে? মোটেই না। কারণ ধূমপানে কোনো রোগ—ই হয় না। ধূমপান হচ্ছে বিশ্বব্যাপী একটা ‘নন্দঘোষ’ বা গিনিপিগ। যেকোনো ধূমপায়ী কোনো রোগে আক্রান্ত হলে, তাকে সিরিয়াসলি বলা হয়, আপনি শুধু ধূমপান করার কারণেই এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। অথচ দেখা যায়, ধূমপান করেন না, এমন অসংখ্য লোকও প্রতিনিয়ত রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছে।

৯. ধূমপান আগে, নাকি ক্যান্সার আগে?

আমি ছোটবেলা থেকে ‘ধূমপানে ক্যান্সার’ হয়, এই কথাটি শুনে আসছি। বিশ্বাসও করতাম। কারণ সবাই একই সূরে কথাটি বলে। আমার মনে হতো, ধূমপান করলে ক্যান্সার থেকে বাঁচার কোনো সুযোগ নেই। মনে হতো, মানুষ ধূমপান না করলে হয়তো ক্যান্সার নামক রোগটির জন্ম—ই হতো না; ধূমপান থেকেই ক্যান্সার রোগের সৃষ্টি। কিন্তু এখন দেখছি, বাস্তবতা উল্টো।

আপনি ক্যান্সারের ইতিহাস পড়ুন। ক্যান্সার মানবজাতির আবির্ভাবের শুরু থেকেই ছিল। আর পৃথিবীতে ধূমপান প্রচলনের বয়স চার—পাঁচশ বছর। ষোড়শ শতকে পৃথিবীতে ধূমপানের প্রচলন হয়। আপনি ধূমপানের ইতিহাস ঘাঁটলেই এই তথ্যটি পাবেন। যদি মানুষের অস্তিত্বের শুরু থেকেই ক্যান্সার মানুষকে আক্রমণ করতে আরম্ভ করে আর ধূমপানের প্রচলন মানুষের অস্তিত্বের অনেক অনেক পরে হয়ে থাকে, তাহলে ধূমপানকে ক্যান্সারের জন্য দায়ী করার কি কোনো সুযোগ থাকে?

১০. ধূমপান কি মদপানের চেয়েও ক্ষতিকর?

কিছু লোক আছে, যারা মদপানের চেয়েও ধূমপানকে ভয়ঙ্কর মনে করে। কিন্তু এসব লোক বাস্তবতা দেখে না। এসব লোকের নিকট প্রশ্ন: ধূমপায়ী ধূমপানের টাকার জন্য কখনো কাউকে হত্যা করার কথা শুনেছেন? শুনেননি। কিন্তু বাংলাদেশে মাদকের টাকা না পেয়ে বাবা, মা বা স্ত্রীকে হত্যা করার অসংখ্য ঘটনা ঘটে প্রতিনিয়ত। আপনি যদি নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা না পড়েন বা এরকম কোনো ঘটনার কথা কোনোভাবে না জানেন, তাহলে গুগলে ‘‘মাদকের টাকা না পেয়ে বাবাকে হত্যা’’ বা ‘‘মাদকের টাকা না পেয়ে স্ত্রীকে হত্যা’’ বা ‘‘মাদকের টাকা না পেয়ে মাকে হত্যা’’ বা ‘‘নেশার টাকা না পেয়ে হত্যা’’ বা ‘‘মাদকসেবীর হাতে খুন’’ এসব লিখে সার্চ করুন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত মাদকাসক্ত ব্যক্তির হাতে তার বাবা, মা, স্ত্রী বা অন্য কেউ হত্যার ভুরি ভুরি সংবাদের লিঙ্ক পেয়ে হতভম্ব হয়ে যাবেন মাদকের ভয়াবহতা দেখে। কিন্তু ধূমপানে আসক্ত মানুষের হাতে এভাবে খুনের ঘটনা একেবারে বিরল।

১১. ধূমপান নাকি মানুষকে মাদকের দিকে ধাবিত করে

যারা মনে করে, ধূমপান মানুষের আর কোনো ক্ষতি না করলেও ‘ধূমপান মানুষকে মদপানের দিকে ধাবিত করে বা ধূমপায়ীরাই মদপান করে বেশি’, কমপক্ষে এই ক্ষতি করে, তাদেরকে যখন প্রশ্ন করা হয়, ‘যেহেতু মাদক ক্ষতিকর, এ ব্যাপারে আপনার কোনো দ্বিমত নেই, তাই মাদককে যদি পৃথিবী থেকে পুরোপুরি দূর করে দেয়া যায়, তখন কি ধূমপান মানুষকে মদপানের দিকে ধাবিত করবে?’, তখন এরা এটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়, পৃথিবী থেকে আগে মাদক দূর করা দরকার।

১২. ধূমপান, নাকি তামাক সেবন ক্ষতিকর?

সিগারেটের প্যাকেটে লেখা থাকে, ‘‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’’। ধূমপান মানে ধোঁয়া পান করা। কিন্তু ধূমপান কেন ক্ষতিকর, সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়, সিগারেটে ব্যবহৃত তামাকে নিকোটিন নামক ‘অতি বিষাক্ত’ পদার্থ থাকার কারণেই মূলতঃ ধূমপান ক্ষতিকর। যদি সিগারেটে ব্যবহৃত তামাকে থাকা নিকোটিন মানুষের সত্যিই ক্ষতি করে, তাহলে ‘ধূমপান ক্ষতিকর’ বলাটা ভুল। বলতে হবে ‘তামাক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’।

তামাকে যদি নিকোটিন থাকে আর নিকোটিন জনস্বাস্থ্যের জন্য অতি ক্ষতিকর হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশে আমাদের মা—চাচী বা বয়জ্যেষ্ঠ যারা আমাদের চোখের সামনে ৪০—৫০ বছর ধরে পানের সাথে জর্দা বা সাদাপাতা খেয়ে আসছেন, কিন্তু এখনো ক্যান্সার বা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হননি, তাদের এখনো কোনো ক্ষতি হয়নি কেন? কত বছর তামাক খেলে মানুষ এসব রোগে আক্রান্ত হয়?

সাদাপাতা, জর্দা, গুল এইসব তামাকজাত দ্রব্য ৩০—৪০ বছর ধরে ব্যবহার করা সত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্যান্সার, ব্রেইন স্ট্রোক এসব রোগে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াই দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। এখনও লক্ষ লক্ষ মানুষ শুধু বাংলাদেশেই খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা ৩০—৪০ বছর ধরে নিয়মিত তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করছেন, তবু এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হননি।

এগুলো ব্যবহারকারী কিছু লোকের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া কোনোভাবে প্রমাণ করে না, তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারেই তারা এসব রোগে আক্রান্ত হয়েছে।

১৩. ধূমপান যদি সত্যিই মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে বিড়ি—সিগারেট এবং তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, আমদানি, ক্রয়—বিক্রয় এবং ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও বন্ধ করে দেয়া হয় না কেন?

ধূমপান ও তামাকের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সব দেশ, প্রায় সব মানুষ একই সূরে কথা বলে। এখনো এমন কোনো গবেষণা পরিচালিত হয়নি, যে গবেষণা বলেছে, ধূমপান ও তামাক বাস্তবে স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি করে না বা যেসব রোগের জন্য ধূমপানকে দায়ী করা হয়, বাস্তবে সেসব রোগে আক্রান্ত হবার সাথে ধূমপানের কোনো সম্পর্ক নেই। সব নিবন্ধ এবং প্রতিবেদন ধূমপানের বিরুদ্ধে। সব দেশ ধূমপানের বিরুদ্ধে এক, কিন্তু সব দেশ একত্র হয়ে পৃথিবী থেকে ধূমপান এবং তামাক সেবন নিষিদ্ধ করে না কেন?

১৪. ধূমপানের ক্ষতির কথা বলে বলে শুধু সিগারেটের উপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর সুপারিশই করা হয়, নিষিদ্ধের সুপারিশ করা হয় না

আপনি ধূমপানের বিরুদ্ধে লেখা কিছু প্রতিবেদন বা ধূমপান—সংক্রান্ত কিছু গবেষণা ফলাফল পড়—ন। দেখবেন সেগুলোর অধিকাংশতেই ধূমপানের মারাত্মক ক্ষতিকর দিকের কথা উল্লেখের পর ধূমপান নিষিদ্ধের সুপারিশ না করে শুধু সিগারেটের উপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর সুপারিশই করা হয়। এটা এক ভন্ডামী। শুল্ক বৃদ্ধির জন্য কোনো কিছু ক্ষতিকর বলে প্রচারের দরকার নেই, নিত্যপণ্য নয়, বরং বিলাসদ্রব্যে শুল্ক এমনিই বৃদ্ধি করা যায়, তা বড় কোনো দোষ নয়। বাংলাদেশে রিকন্ডিশন বা ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির শুল্কের হার এটাই প্রমাণ করে।

১৫. বিভিন্ন গুরুতর রোগের জন্য ধূমপানকে একতরফাভাবে দায়ী করার ফলে কী হচ্ছে?

ধূমপানকে এভাবে একতরফা বিভিন্ন রোগের কারণ বলে দায়ী করার ফলে কী হচ্ছে? রোগগুলোর প্রকৃত কারণ আমাদের দৃষ্টির বাইরে থেকে যাচ্ছে। যেভাবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের সঠিক কারণ এখনো অনেকের দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেছে। প্রথম অনুচ্ছেদেইে বলা হয়েছে ধূমপানের সাথে হার্ট অ্যাটাক (হৃদরোগ), উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কোনোই সম্পর্ক নেই। আপনি ১০০ জন ডায়াবেটিস রোগীর (মহিলাসহ) খোঁজ নিন। দেখবেন, তাদের অধিকাংশই ধূমপান করেন না। এভাবে উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের (মহিলাসহ) খোঁজ নিলেও দেখবেন তাদের অধিকাংশই ধূমপান করেন না। ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকের পাশাপাশি এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হবার জন্যেও ধূমপানকে দায়ী করা হয়। এই তিনটি রোগের কোনোটিতে আক্রান্ত হবার পর একজন লোক চিকিৎসকের কাছে গেলে চিকিৎসক রোগীকে জিজ্ঞেস করে যখন জানতে পারেন, রোগী ধূমপায়ী, তখন তিনি রোগীকে বলেন, ধূমপানের কারণেই আপনি এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এই বার্তাাগুলো সাধারণ মানুষের নিকট গেলে (১) যারা ধূমপান করেন না, তারা ভাবে, আমি যেহেতু ধূমপান করি না, তাই আমি এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হবো না। এভাবে রোগগুলোর সত্যিকারের কারণ থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নেয়ার ফলে মানুষ রোগগুলোর সত্যিকারের কারণ সম্পর্কে বিভ্রান্তিুতে থেকে যাবার ফলে রোগগুলো প্রতিরোধের কোনো পন্থা অবলম্বন করার সুযোগ পায় না বলেই অসংখ্য মানুষ এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হচ্ছে। অন্যদিকে (২) যারা ধূমপান করেন, কিন্তু এখনো এই রোগগুলোর কোনোটিতে আক্রান্ত নন, তারা ভাবেন, আমি যেহেতু ধূমপান করছি, তাই ধূমপান ত্যাগ করলেই এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ হয়ে যাবো। না করলে নয়। এই চিন্তা করে তারা ধূমপান ছেড়ে দিলেও রোগগুলো থেকে নিরাপদ হয় না। কারণ ধূমপানের কারণে নয়, বরং অন্য কারণে মানুষ রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়। সত্যিকারের কারণ না জানার কারণে তারা রোগগুলো প্রতিরোধের সঠিত পন্থা অবলম্বনের সুযোগ পায় না বলে রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

হয়তো ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকের জন্যেও একতরফাভাবে ধূমপানকে দায়ী করার ফলে এই রোগ দুইটির সত্যিকারের কারণও আমাদের দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেছে।

১৬. ধূমপানে কি তাহলে ফুসফুস ক্যান্সার হয়?

অনেক বলে থাকেন, ধূমপানে মানুষ আর কোনো রোগে আক্রান্ত না হলেও ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় বা ফুসফুস ক্যান্সারের সবচেয়ে বড় কারণ ধূমপান। কিন্তু তারা কি কখনো দেখে না, ধূমপান করেন না, এমন মানুষরাও অহরহ ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়?

চায়নার ‘গুয়াংজৌ ক্যান্সার হসপিটালের’ ওয়েবসাইটে (বাংলা) ‘ফুসফুস ক্যান্সার’ শিরোনামে একটা লেখায় বলা হয়েছে, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৯০% ক্ষেত্রেই ফুসফুস ক্যান্সার তাদের হয়, যারা ধূমপান করেন। তার মানে যারা ধূমপান করেন না তাদের কি এই ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা নেই? আসলে ব্যাপারটা এমন নয়। মডার্ন ক্যান্সার হসপিটাল গুয়াংজৌ দেখেছে যে, এখন পর্যন্ত ফুসফুস ক্যান্সারের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। সুতরাং ধূমপান—ই না, এর সাথে আরও তিনটি কারণ জড়িত থাকতে পারে— ১. বায়ু দূষণ, ২. অতিরিক্ত প্রেসার, ৩. পুষ্টির অভাব। এছাড়াও ভাইরাল ইনফেকশন, মাইকোটক্সিন, টিউবারকুলসিস, ইমিউন ডিসফাঙ্কশন, এন্ডওক্রাইন ডিজঅর্ডার এবং জেনেটিক কারণেও ফুসফুস ক্যান্সার হতে পারে।’


এখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘‘মডার্ন ক্যান্সার হসপিটাল গুয়াংজৌ দেখেছে যে, এখন পর্যন্ত ফুসফুস ক্যান্সারের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি।’’

১৭. ধূমপানে ক্যান্সার হয় না, তা একটি গবেষণায় প্রমাণিত

ধূমপানে যে ক্যান্সার হয় না, তা একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। ‘‘ধূমপান কমিয়ে লাভ নেই — ব্রিটেনে নতুন গবেষণা’’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের (বিএমজে) এক গবেষণা বলছে, দিনে একটি সিগারেট খেলেও হৃদরোগের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। স্ট্রোক বা মস্তিস্কে ক্ষরণের ঝুঁকিও বাড়ে ৩০ শতাংশ।

সেখানে আরো বলা হয়, ‘‘ধূমপানের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ক্যানসার নয়, বরঞ্চ হৃদরোগ। ধূমপানের ফলে মৃত্যুর ৪৮ শতাংশই হয় হৃদরোগ থেকে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রিটেনে সামগ্রিকভাবে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমছে ঠিকই কিন্তু দিনে একটি থেকে পাঁচটি সিগারেট খায়, এমন মানুষের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বাড়ছে।

দিনে অন্তত ২০টি সিগারেট খান, এরকম ১০০ ধূমপায়ীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের সাত জনই হয় হার্ট অ্যাটাক, না হয় স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন।’’

এই গবেষণা স্পষ্ট করেছে, ‘‘ধূমপানের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ক্যানসার নয়..’’

কিন্তু ধূমপানে হৃদরোগ বা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার যে তথ্য তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, তার কারণ, গবেষকরা এই দু’টি রোগের সঠিক কারণ সম্পর্কে দ্বিধায় ছিলেন।

তারা যেসব ধূমপায়ীর উপর সমীক্ষা চালিয়েছেন, সেসব ধূমপায়ীর শরীরে চর্বি—কোলেস্টেরল বেড়ে যাবার কারণেই তারা মূলত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যা হৃদরোগে আক্রান্ত হবার মূল কারণ। আর যারা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া প্রমাণ করে না, তারা ধূমপানে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। কারণ গবেষণায় বলা হয়, ‘‘দিনে অন্তত ২০টি সিগারেট খান, এরকম ১০০ ধূমপায়ীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের সাত জনই হয় হার্ট অ্যাটাক, না হয় স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন।’’

১০০ জন ধূমপায়ীর মধ্যে মাত্র ৭ জন হয়তো হৃদরোগ, না হয় ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। বাকি ৯৩ শতাংশের বেশি ধূমপায়ী ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত না হওয়া এবং অধূমপায়ী মানুষরাও ব্রেইন স্ট্রোকে অহরহ আক্রান্ত হওয়া প্রমাণ করে, এই ৭ জনের মধ্যে যারা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা ধূমপান না করলেও ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হতেন।

ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল (বিএমজে) যেই ১০০ জন ধূমপায়ীর ওপর গবেষণা চালিয়েছে, তাদের কেউই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়নি। অন্য ১০০ জন ধূমপায়ীর ওপর গবেষণা চালালে হয়তো দেখা যেতো, তাদের কেউ কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। তখন কি তাদের ক্যান্সারের জন্য ধূমপানকে দায়ী করা ঠিক হতো? ঠিক তখনই হতো, যদি ক্যান্সারে শুধু ধূমপায়ীরাই আক্রান্ত হতো, যা প্রথম পয়েন্টে বলা হয়েছে।

এই গবেষণা প্রতিবেদন বিবিসি নিউজের ওয়েবসাইটে 'One cigarette a day 'increases heart disease and stroke risk' শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ January ২০১৮ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘‘Cardiovascular disease, not cancer, is the greatest mortality risk for smoking, causing about 48% of smoking-related premature deaths’’

১৮. ক্যান্সারের কোনো কারণ এখনো কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না

নির্দিষ্ট করে ক্যান্সারের কোনো কারণ এখনও কেউ খুঁজে পায়নি। American Cancer Society’র অনলাইনে What is Cancer? শিরোনামের আরেকটি নিবন্ধের Why did this happen to me? উপশিরোনামে বলা হয়েছে, ‘‘People with cancer often ask, ‘What did I do wrong?’ or ‘Why me?’ Doctors don’t know for sure what causes cancer. When doctors can’t give a cause, people may come up with their own ideas about why it happened.

Some people think they’re being punished for something they did or didn’t do in the past. Most people wonder if they did something to cause the cancer.

If you’re having these feelings, you’re not alone. Thoughts and beliefs like this are common for people with cancer. You need to know that cancer is not a punishment for your past actions. Try to not blame yourself or focus on looking for ways you might have prevented cancer. Cancer is not your fault, and there’s almost never a way to find out what caused it. Instead, focus on taking good care of yourself now.’’

এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘‘Doctors don’t know for sure what causes cancer. When doctors can’t give a cause, people may come up with their own ideas about why it happened.’’ অবাক লাগে, তবু মানুষ এটাসেটাকে ক্যান্সারের কারণ বলে প্রচার করে কিভাবে!


ক্যান্সার কেন হয়: আগের ধারণা ‘বদলে দেবে’ নতুন গবেষণা’ শিরোনামে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কমে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বায়ু দূষণ কী করে শরীরে ক্যান্সার বাসা বাঁধার কারণ হয়ে উঠতে পারে, এক গবেষণায় সেই রহস্য উন্মোচনের কথা জানিয়েছেন গবেষকরা।

যারা ধূমপানে অভ্যস্ত নন, তারাও কেন ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, তা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই নতুন এ ধারণার জন্ম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ ধূমপান। কিন্তু দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে প্রতি দশ জনে একজন ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন বায়ু দূষণের কারণে।

ক্রিক ইনস্টিটিউটের গবেষকদের একজন এমিলিয়া লিম বলেন, “জীবনে কখনও ধূমপান না করেও ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্তরা বুঝতে পারেন না কেন তাদের এই রোগ হল। তাদেরকে সেই কারণ বোঝানোর জন্য এই গবেষণা জরুরি ছিল।

১৯. ক্যান্সার এবং ধূমপানের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা হয় উল্টোপথে

ধূমপানে ক্যান্সার হয়, এমন তথ্য প্রায় সব গবেষণায় উঠে আসে। এর কারণ আছে। ধূমপান একটি গিনিপিগ বলেই এই সমস্যা। ধূমপান নিয়ে গবেষণাগুলোও হয় উল্টে পথে। যেমন কোনো ক্যান্সার হাসপাতালে বা কোনো এলাকায় ক্যান্সারে আক্রান্ত নির্দিষ্ট কিছু রোগীর উপর পর্যবেক্ষণ করে যখন দেখা যায়, তাদের অনেকেই ধূমপানে আসক্ত ছিল, তখন ধূমপানকেই ক্যান্সারের কারণ বলে গণ্য করা হয়। যেমন যখন দেখা যায়, প্রতি চারজন ক্যান্সার রোগীর মধ্যে একজনের রোগটি হয় ধূমপানের কারণে, তখন নিশ্চিন্তে মন্তব্য করা হয়, ধূমপানের সাথে ক্যান্সারের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

ধূমপানের সাথে ক্যান্সারের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণার সঠিক পন্থা হতে পারে এমন— (১) কোনো একটি ক্যান্সার হাসপাতালে গিয়ে বা কোনো এলাকার ক্যান্সার আক্রান্ত ১০০ জন লোকের উপর পর্যবেক্ষণ করে যদি দেখা যায়, ক্যান্সারে আক্রান্ত ওই ১০০ জন রোগীর সবাই ধূমপায়ী অথবা (২) যেসব গোষ্ঠি বা শ্রেণির মানুষ সাধারণত ধূমপান করেন না বা যাদের মধ্যে হাজারেও একজন ধূমপান করেন না, যেমন বাংলাদেশের নারীরা বা মাদ্রাসা শিক্ষিত মানুষরা, যদি দেখা যায়, তারা কেউই কখনো ক্যান্সারে আক্রান্ত হন না, বরং অন্যরা, যারা ধূমপানের সাথে জড়িত, তারাই ক্যান্সারে আক্রান্ত হন অথবা (৩) ৩০ বছর ধরে নিয়মিত ধূমপান করেছেন, এমন ১০০ জন লোকের মধ্যে ৮০ জনের বেশি ক্যান্সারে বা ব্রেইন স্ট্রোকে বা উভয় রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তাহলেই ধূমপানে ক্যান্সার হয় বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

২০. ধূমপানে সত্যিই মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় কিনা? আমার মনে কেন এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে?

দৈনিক ইনকিলাবে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে ‘অতিরিক্ত আরামই ব্যারামের কারণ’ শিরোনামে। সেই লেখাটিকে আরো বিস্তৃত পরিসরে লিখতে গিয়ে আমি যখন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এই রোগগুলোর সত্যিকারের কারণ পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করার পর এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার জন্য সচরাচর যে কারণগুলো প্রচার করা হয়, সেগুলোর একটি একটি করে চুলচেরা বিশ্লেষন শুরু করি, তখন দেখি, এই রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে বেশ কিছু নিবন্ধ/প্রতিবেদনে ধূমপানকেও এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। এরপর আমি ধূমপানের সাথে এই রোগগুলোর সম্পর্কের গভীরে গিয়ে দেখি, ধূমপানের সাথে এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হবার যেমন কোনো সম্পর্ক নেই, ধূমপানের সাথে ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবারও কোনোই সম্পর্ক নেই। সবই গুজব।

২১. ধূমপান নয়, বরং মদপান ক্ষতিকর

আমার ওই লেখায় আমি ধূমপানের সাথে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার সম্পর্ক নিয়ে একটি আলাদা অধ্যায় যুক্ত করি। অধ্যায়টির শিরোনাম, ‘ধূমপান নয়, বরং মদপান ক্ষতিকর’। সেই অধ্যায়টি পড়ে দেখলে ধূমপান সম্পর্কে মানুষের যেই ধারণা, তা সমূলে পাল্টে যাবে। পৃথিবীতে অনেক ভন্ডামী আছে। মদপানে পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যাবার পরও মদপানের বরুদ্ধে অনেক দেশেই যথাযথ পদক্ষেপ নেই। ধূমপান নিয়ে প্রায় সব দেশেই অতিরিক্ত কড়াকড়ি। এসব ভন্ডামী দূর হওয়া দরকার।

লেখাটি হচ্ছে: ধূমপান নয়, বরং মদপান ক্ষতিকর

২২. আমি কাউকে ধূমপান করতে বলি না

আমি দেখেছি, ধূমপানের সাথে কোনো রোগে আক্রান্ত হবার সম্পর্ক নেই। তবু আমি নিজেও যেমন ধূমপান করি না, কাউকে ধূমপান করতেও বলি না। কারণ (১) ধূমপানে শরীরে কোনো রোগ সৃষ্টি না হলেও ধূমপানের কারণে মানুষের মুখে যে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়, তা অবশ্যই বিরক্তিকর; (২) ধূমপানে বাড়তি অর্থ খরচ হয়। অনেক মানুষ দুবেলা ঠিকমতো খেতে পায় না, তবু ধূমপান ঠিক রাখে। তবে ধূমপান ছাড়াও মানুষের অনেক নেশা আছে। অনেকে চা খেতে অভ্যস্ত, অনেকে পান খেতে অভ্যস্ত। আমাদের এলাকার একজন রিকশাচালক আছে ইব্রাহিম নামে। সে দিনে বিশ খিলির মতো পান খায়। এটাকে আপনি নেশাও বলতে পারেন। অনেকে দিনে দু’বার বা তার চেয়ে বেশি চা খায়। কখনো সময়মতো চা না খেলে তার শরীরে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এটাকেও নেশা বলার সুযোগ আছে।

২৩. বৈশ্বিক বিশ্বাসে ত্রুটির প্রমাণ

পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ একই সাথে একটি ভুল ধারণায় বিশ্বাসী হতে পারে, এমন কথা হয়তো কেউ কল্পনাও করতে পারেন নি। ধূমপান নিয়ে আমার লেখালেখির আরেকটি উদ্দেশ্য হতে পারে মানুষের চোখের সামনের ভুল ধরিয়ে দেয়া। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে আমি একটি বই লিখেছি ‘‘করোনাভাইরাসের প্রকৃত রহস্য’’ শিরোনামে। বইটিকে শুধু করোনাভাইরাসের প্রকৃত রহস্যের হাঁড়ি হাঁটে ভেঙ্গে দেয়া হয়নি, দিবালোকের মতো পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে, ভাইরাস এবং রোগজীবাণু নামে আলাদা কোনো কিছুই নেই, যা আমাদের শারীরিক কোনো ক্ষতি করতে পারে।

Next Post Previous Post