ডায়াবেটিস থেকে আমি এখনো বেঁচে আছি, আপনিও বাঁচুন
ডায়াবেটিস থেকে আমি এখনো বেঁচে আছি, আপনিও বাঁচুন
নূর আহমদ
আমার বয়স এখন ৪৪ বছর।
আমি এখনো ডায়াবেটিস থেকে বেঁচে আছি। এবং আমি বিশ্বাস করি, আমি এখন যেই উপায়ে ডায়াবেটিস
থেকে বেঁচে আছি, যতোদিন এই উপায় অবলম্বন করতে পারবো, ততোদিন ডায়াবেটিস আমাকে
আক্রমণ করতে পারবে না।
আপনি হয়তো বলতে পারেন,
৪৪ বছর বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হওয়া অবাক করার মতো কিছু নয়। অনেক মানুষ কোনো
উপায় অবলম্বন না করেও আরো বেশি বয়সেও ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকে।
আমি আপনাকে দুইটি বিষয়
বুঝিয়ে বলছি, (১) কেন ৪৪ বছর বয়সে ডায়াবেটিস থেকে বেঁচে থাকতে পারাটা বিশেষ কিছু?
(২) কোনো উপায় অবলম্বন না করেও কিছু কিছু মানুষ কেন আরো বেশি বয়সেও ডায়াবেটিস
থেকে নিরাপদ থাকে?
আমাদের যাদের বয়স ৫০
বছরের কাছাকাছি, আমরা দেখেছি, আমাদের ছোটবেলায় মানুষ এখনকার মতো এতো ব্যাপক হারে
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো না। শেষ বয়সে কেউ কেউ সাংসারিক কাজকর্ম থেকে পুরোপুরি
অবসরে চলে গেলে যখন কায়িক শ্রম থেকে দূরে সরে গিয়ে আরামে আরামে থাকতে শুরু করতো,
তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো।
এখন যেভাবে প্রায় প্রতি
ঘরে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে, তখন প্রতি ঘরে এভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
মানুষ পাওয়া যেতো না। এখন যেভাবে ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষরাও ব্যাপকহারে ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত হচ্ছে, তখন এই বয়সে মানুষ ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত হতো একেবারে কম।
এখন শুধু ৫০ বছরের বেশি
বয়সী মানুষরা নয়, ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষরাও নয়, ৩০ বছরের কম বয়সী অনেক যুবক, এমনকি
অনেক শিশুও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
এর কারণ কি? আগে কেন ৭০-৮০
বছর বয়স হওয়া ছাড়া মানুষ ডায়াবেটিসে তেমন
আক্রান্ত হতো না, আর এখন মানুষ কেন বয়স অনেক কম থাকতেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে?
কেন মানুষ আগে ডায়াবেটিসে খুব কম আক্রান্ত হতো?
এর কারণ একটাই। আর সেটা
হলো আগের মানুষের নিয়মিত কায়িক শ্রম করা এবং এখনকার মানুষের কায়িক শ্রম থেকে দূরে
থাকা। আগের মানুষরা কায়িক শ্রম ছাড়া একটা
দিনও কাটাতে পারতো না। উদ্দেশ্যমূলকভাবে নয়, বরং অনিচ্ছাকৃতভাবেই মানুষকে তখন কায়িক
শ্রম করতে হতো। মানুষের জীবন চলার পথ ছিল কায়িক শ্রমে ভরপুর। প্রাত্যহিক জীবনের
প্রায় সব কাজে ছিল প্রচুর কায়িক শ্রম।
কৃষিকাজের সাথে প্রায় সব
মানুষ জড়িত ছিল। কৃষিকাজ করার কারণে পুরুষদের যেমন অনেক শারীরিক পরিশ্রম হতো, মহিলাদেরও
অনেক শারীরিক পরিশ্রম হতো। সব পরিবারের রান্নাঘরে থাকতো ঢেঁকি। ঢেঁকিতে কাজ করতে
হতো প্রায় সব মহিলাকে। ঢেঁকিতে কাজ করাটা কতোটা কষ্টসাধ্য, তা যারা ঢেঁকিতে কখনো কাজ করেছেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন।
মানুষ কোথাও যেতে হতো হেঁটে
হেঁটে। অনেক দূরের গন্তব্যেও মানুষ হেঁটে হেঁটেই চলে যেতো। মানুষের আরামে থাকার
সুযোগ ছিল একেবারে কম। এই জন্য মানুষ তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্তই হতো না, যতোদিন
সাংসারিক কাজে লিপ্ত থাকতো। সাংসারিক কাজ থেকে পুরোপুরি অবসরে চলে গেলেই কেউ কেউ ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত হতো ।
এখন আর আগের মতো কায়িক শ্রম নেই
কিন্তু এখন আর আগের মতো
মানুষের জীবন চলার পথে কায়িক শ্রম নেই। এখন আরাম-বান্ধব প্রযুক্তির জয় জয়কার।
মানুষ এখন চাইলেই ২৪ ঘন্টা আরামে আরামে কাটিয়ে দিতে পারে। কৃষিকাজ থেকে অনেক মানুষ
এখন দূরে। মানুষ এখন শহুরে জীবন বেশি পছন্দ করে। শহুরে জীবনে কায়িক শ্রম একেবারে
কম। যেসব কাজে কায়িক শ্রম আছে, মানুষ সেসব কাজ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। সিঁড়ির
পরিবর্তে লিফট ব্যবহার করে। দুই তিন কিলোমিটার দূরত্বের পথ হেঁটে যাওয়া অনেকে
কল্পনাও করতে পারে না। মানুষ যানবাহনে বসে বসে যেতেই পছন্দ করে।
কৃষিকাজ থেকে দূরে সরে
গিয়ে মানুষ বাজার থেকে কিনে খেতেই পছন্দ করে। মহিলাদের কায়িক শ্রমের সুযোগও এখন
তেমন নেই। মানুষের রান্নাঘর থেকে ঢেঁকি বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই।
জামাকাপড় ধোয়ার কাজও
মানুষ নিজ হাতে না করে ওয়াশিং মেশিন দিয়ে করতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। মশলা বাটার কাজও
করে দিচ্ছে ইলেকট্রিক মেশিন। রান্নাবান্নাও করতে পারছে গ্যাসের চুলায় বা ইলেকট্রিক
চুলায়।
মানুষ এখন আরামকেই প্রায়
সর্বক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়। মানুষের অধিকাংশ পেশা এখন শারীরিক পরিশ্রমহীন। বসে
বসে কাজ করে করে মানুষের শরীরে এনার্জি শুধু জমাই হয়, খরচ হয় না। এর ফলে মানুষের শরীরে
কোলেস্টেরল বেড়ে যায়।
কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া থেকেই হয় ডায়াবেটিস
শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে
যাওয়া থেকেই মানুষের শরীরে জন্ম নেয় ডায়াবেটিস।
অনেক শিশু খেলাধুলা করার
সুযোগ পায় না। অন্যদিকে স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে সময় কাটায়।
এই সব কারণে মানুষকে এখন আর বৃদ্ধ হতে হয় না, বৃদ্ধ হবার আগেই, শিশু-যুবক থাকতেই মানুষকে
ধরে ফেলে ডায়াবেটিস। মধ্য বয়সে যাওয়া পর্যন্তও
অপেক্ষা করতে হয় না।
দেখবেন, মানুষ এখন স্থূল
হয়ে যাচ্ছে বেশি। আগে মানুষ সহজে স্থূল
হতো না। মানুষ বেশি বেশি কায়িক শ্রম করার কারণে এনার্জি আর্নের চেয়ে বার্ন হতো
বেশি। মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল জমা হতে না পারার কারণে আগে মানুষ সহজে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো না।
স্থূলতাও ডায়বেটিসের আরেক কারণ
কিন্তু এখন মানুষ স্থূল
হয়ে যায় বেশি। মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায় অল্প বয়সেই। তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে সময় লাগে না।
এবার আমার নিজের কথায়
আবার ফিরে আসি। আমি ছোটবেলা থেকেই নিয়মিত কায়িক শ্রম করতাম। জানতাম না, নিয়মিত
কায়িক শ্রম করলে মানুষ ডায়াবেটিস থেকে
নিরাপদ থাকে। না জেনেই আমি নিয়মিত কায়িক শ্রম করতাম। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কায়িক শ্রম
করতাম, তা নয়, বরং আমাকে বাধ্য হয়েই নানানভাবে কায়িক শ্রম করতে হতো। কিন্তু আমার
পরিচিত অনেক মানুষকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে, কষ্ট পেতে এবং মারা যেতে দেখে আমার
মনে ২০১৫ সালের দিকে ডায়াবেটিসের কারণ
নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়। আমার নিজ প্রয়োজনে আমি ডায়াবেটিসের কারণ খুঁজতে শুরু করি।
খুঁজতে খুঁজতে এক সময় আমার নিকট দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়, ডায়াবেটিস বংশগত
কারণে হয় না, ডায়াবেটিস মিষ্টি খেলে হয় না, টেনশনেও ডায়াবেটিস হয় না, ধূমপানেও
ডায়াবেটিস হয় না, বয়স বেড়ে যাবার সাথেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্পর্ক নেই। বরং
শুধুই কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকার কারণে মানুষের শরীরে যখন কোলেস্টেরল বেড়ে যায়,
তখনই মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। এই বিষয়টা আমার নিকট পরিষ্কার হয়ে যাবার পর
আমি কায়িক শ্রমকে আমার নিজের জন্য আরো আবশ্যকীয় করে নিয়েছি। আরামে থাকার বেশ কিছু
অপশনকে আমি দূরে ঠেলে রাখি। শুধু এই জন্যই এখনো আমি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হইনি, এটা
আমি নিশ্চিত।
আমার চেয়ে কম বয়সী অনেক
মানুষকে আমি চিনি, যারা আরো অনেক আগেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে, শুধুই কায়িক
শ্রম থেকে দূরে থাকার কারণে। এটা হচ্ছে একটা দিক। আরেকটা দিক হচ্ছে, আমার পরিচিত বেশ
কিছু মানুষ আছেন, যাদের বয়স আমার চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যাবার পরও তারা ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত হননি। অনেকের বয়স ৭০ এর চেয়েও বেশি, তবু ডায়াবেটিসে এখনো আক্রান্ত হননি।
এরা এখনো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হননি শুধু নিয়মিত কায়িক শ্রম করে যাবার কারনে।
কায়িক শ্রমে নিযুক্ত মানুষগুলোর দিকে তাকান
আপনি দেখবেন, আপনার
পরিচিত যেই সব মানুষ কায়িক শ্রমের বিভিন্ন পেশায় অনেক বছর ধরে নিয়োজিত, তাদের বয়স অনেক
বেশি হয়ে যাবার পরও তারা ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ। তাদের অনেকে মিষ্টি খেতে দ্বিধা
করেন না, অনেকেই বিভিন্ন সময় মারাত্মক টেনশনে ভোগে, অনেকের বাবা মা বা পূর্বপুরুষদের
কেউ না কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, অনেকেই ধূমপানও করেন, তবু বয়স অনেক বেশি হয়ে
যাবার পরও ডায়াবেটিস থেকে পুরোপুরি মুক্ত আছেন, শুধু নিয়মিত কায়িক শ্রম করার ফলে
তাদের শরীরে কোলেস্টেরল জমা হতে না পারার কারণে।
এই লোকগুলোই নিজের
অজ্ঞাতসারে ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকে। এরা জানে না, নিয়মিত কায়িক শ্রম করলে যে
মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। এরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কারণ না জেনেও, ডায়াবেটিস
থেকে বাঁচার উপায় না জেনেও ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকছে শুধুই নিয়মিত কায়িক শ্রম
করে যাবার কারণে, এদের শরীরে কোরেস্টেরল বাড়তে না পারার কারণে।
বেশি বয়সেও কিছু মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না কেন?
আপনি দেখুন, আপনার
পরিচিত যারা ৫০ বছিরের বেশি বয়স হয়ে যাবার পরও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হননি, তারা
হয়তো নিয়মিত কায়িক শ্রম করছে, না হয় কম কম খাচ্ছে। যার ফলে তাদের শরীরে কোলেস্টেরল
বাড়তে পারছে না এবং এই জন্যই তারা ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকছে।
অন্যদিকে আপনার পরিচিত
যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, খোঁজ নিলে দেখবেন, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার আগে
নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিামণে কায়িক শ্রম করতো না, তারা মনের চাহিদামতো খেতো, যার ফলে
তাদের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায় এবং তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
ডায়াবেটিস থেকে যদি নিরাপদ থাকতে চান
আপনিও যদি ডায়াবেটিস
থেকে নিরাপদ থাকতে চান, সুস্থ সুন্দর, স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চান, দীর্ঘজীবন
লাভের সম্ভাবনা বাড়াতে চান, নিয়মিত অন্তত ৪০ মিনিট ঘাম ঝরানো কায়িক শ্রম বা
ব্যায়াম করুন। নিশ্চিতভাবে আপনি ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকবেন, যতোদিন তা করবেন।